বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত শহর ভারতের মুম্বাই, যেখানে জীবিকার জন্য মানুষ ছুটছে উড়ন্ত মনে। সেজন্য কখনো চলতে হয় লোকে লোকারণ্য লোকাল ট্রেনে, কাকডাকা ভোরে। চলার পথে যেখানে পা রেখে ভালোমত দাঁড়াবার জায়গা পাওয়া যায় না, সেখানে হাতে টিফিনবক্স হাতে নিয়ে কর্মস্থল পর্যন্ত আস্ত নিয়ে যাওয়া এক অসম্ভব ব্যাপার।
আবার অত সকালে রান্নাবান্না করে খাবার নেয়া সেটাও এক এক অগ্নিপরীক্ষা। তাহলে ছুটে চলা এসব মানুষ কি প্রিয়জনের তৈরি সুস্বাদু খাবার দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারবে না? কিন্তু কীভাবে খাবার পৌঁছবে শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে? সেই পৌঁছে দেওয়ার কাজটিই করে থাকেন ডাব্বাওয়ালারা। শুধুই পৌঁছে দেয়া, এর বেশি কিছুই নয়। বাড়ির খাবার আর কর্মস্থলের মাঝের যোগসূত্র স্থাপনই তাদের একমাত্র কাজ।
১৮৯০ সালে যখন ভারতবর্ষে রমরমা অবস্থা ব্রিটিশদের। তখন ব্রিটিশদের প্রয়োজনে মুম্বাইয়ের অফিসগুলোতে বাড়িতে তৈরি খাবার পৌঁছে দেবার জন্য যাত্রা শুরু করে ডাব্বাওয়ালারা।
১০০ জন লোকবল নিয়ে খাবার পৌঁছানোর এ কাজ শুরু করেন মহাদেব হাভাজি বাচ্চে। সেই ১০০ জন থেকে বেড়ে একসময় ডাব্বাওয়ালার সংখ্যা দাঁড়ায় ৫,৫০০ জনে। যাদের মোট গ্রাহক ছিলেন প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার । এই ডাব্বাওয়ালাদের কল্যাণেই কর্মব্যস্ত মানুষ দুপুরের মধ্যে মধ্যাহ্নভোজের ছোট্ট বিরতিতে মানুষ অনায়াসে বাসায় তৈরি খাবারের স্বাদ নিতে পারে।
তবে ডাব্বাওয়ালাদের বিশেষত্ব শুধু খাবার পৌঁছে দেয়াতে নয়, তাদের মূল দক্ষতার জায়গা হলো যে নিষ্ঠা ও সময়ানুবর্তিতার সাথে তারা তাদের কাজ করে। সিক্স সিগমা রেটিংয়ে তাদের নম্বর হলো ৯৯.৯৯৯৯। এর অর্থ তাদের ব্যর্থতার অনুপাত হলো প্রতি ষাট লাখে একবার! সেই ব্যর্থতা মানে কিন্তু আবার ভুল ঠিকানায় খাবার পৌঁছানো নয়। এই ব্যর্থতা মানে হচ্ছে ঠিক সময়ে খাবার তার গন্তব্যে পৌঁছায়নি।
ভাবা যায়! পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত শহরে কোনো আধুনিক যানবাহন ব্যবহার না করে, শুধু সাইকেল, ট্রেন আর হেঁটে প্রতিদিন কাঁটায় কাঁটায়, বছরের পর বছর ধরে তারা সেই ডাব্বা বা লাঞ্চবক্স পৌঁছে দিয়েছেন।
যেখানে অর্ধেক দূরত্বে আধুনিক ফুড ডেলিভারি সার্ভিসগুলো নেয় ৬০ রূপি, সেখানে ডাব্বাওয়ালারা নেয় মাত্র ৫ রূপি! কীভাবে তারা এতদিন ধরে সময়মতো এ কাজ করে যাচ্ছে। তাও একদম শতভাগ পরিবেশসম্মত উপায়ে, যেখানে কিছু পরিমাণে ‘ইকো-ফ্রেন্ডলি’ হলেই আধুনিক ব্র্যান্ডগুলো তাদের সেবা মূল্য বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে, সেখানে কীভাবে এতো কমে তারা দশকের পর দশক ধরে নামমাত্র মূল্যে সেবা প্রদান করতে?
এর পেছনে রয়েছে খুবই চমৎকার একটি কাঠামো, যে কাঠামো ধরে পুরো মুম্বাইয়ের ডাব্বাওয়ালারা কাজ করে। কাঠামোটি আসলে খুবই সহজ, যার মূলে রয়েছে ‘টিম-ওয়ার্ক’।
ডাব্বাওয়ালারা কখনো এককভাবে কাজ করে না, তারা কাজ করে দলবদ্ধভাবে, এমনকি তাদের মধ্যে কোনো উঁচু-নিচু পদও নেই। তারা সবাই ডাব্বাওয়ালা, লাভের সমান অংশীদার। এ কারণেই তাদের আজ এই কর্মদক্ষতা।
ডাব্বাওয়ালারা দিনের কাজ শুরু করে সকাল ৯টায়। তারা প্রথমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবারভর্তি ডাব্বাগুলো সংগ্রহ করেন। প্রত্যেক ডাব্বাওয়ালার এলাকা নির্দিষ্ট করা থাকে, একজন ডাব্বাওয়ালা গড়ে ৪০-৫০টি ডাব্বা সংগ্রহ করেন।
তারপরে সেগুলোকে বাইসাইকেলে করে নিকটস্থ রেল স্টেশনে পৌঁছ দেন। সেখানে অন্যান্য এলাকা থেকে আরো ডাব্বাওয়ালা এসে পৌঁছায়। এরপর সবগুলো ডাব্বা একত্র করে নির্দিষ্ট গন্তব্য অনুযায়ী অনুযায়ী সাজায়। প্রথম ধাপে ভিন্ন ভিন্ন এলাকা থেকে আনা ডাব্বাগুলোকে অফিস অনুযায়ী সাজিয়ে একটি বিশেষ কাঠের পাটাতনে চাপিয়ে তুলে দেওয়া হয় সেই একই অফিস বা কাছাকাছি ভিন্ন ভিন্ন অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাব্বাওয়ালার মাথায়। একজন ডাব্বাওয়ালা গড়ে ৬০টি খাবারভর্তি টিফিনবক্স বহন করেন। একেকজন ডাব্বাওয়ালা তাদের গন্তব্যের ডাব্বাগুলো নিয়ে উঠে পড়েন লোকাল ট্রেনে, এটা হলো দ্বিতীয় ধাপ।
নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছানোর পর হয় আরেকদফা বাছাই। এখানে আবার অফিস অনুযায়ী ডাব্বাগুলো ট্রলিতে সাজিয়ে ডাব্বাওয়ালারা ছুটে চলেন। রাস্তার ট্রাফিক জ্যাম, ফুটপাতে পথচারীর ভীড়- সবকিছু উপেক্ষা করে দুপুর একটার আগেই আড়াই লক্ষাধিক কর্মজীবীর কাছে পৌঁছে যায় ঘরে তৈরি সুস্বাদু খাবার।
তবে সম্প্রতি ডাব্বাওয়ালারা খুবই সংকটে দিন যাপন করছেন। করোনা দখনে ডাব্বাওয়ালাদের ব্যবসা এখন ভালো যাচ্ছে না। দুই দফায় সমগ্র ভারত লকডাউনের কারণে কার্যত সকল ডাব্বাওয়ালা কর্মহীন হয়ে পড়েন। যেখানে অফিস বন্ধ, সেখানে আর অফিসে খানা খাবে কে! অনেকেই দীর্ঘদিনের পেশা ছেড়ে অন্য কাজে চলে গেছেন। কেউ কেউ চলে গিয়েছেন মুম্বাই ছেড়ে, তাদের আদি নিবাসে।