
যুদ্ধ বিমান
পাকিস্তান-ভারতের সাম্প্রতিক সংঘাতে প্রথমবারের মতো সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয় চীনের তৈরি জে-১০সি ‘ভিগোরাস ড্রাগন’ যুদ্ধবিমান। আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন এই মাল্টিরোল ফাইটার জেট শুধু পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষা সক্ষমতাই বৃদ্ধি করেনি, বরং চীনের প্রতিরক্ষা খাতে বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের নতুন দিকও উন্মোচন করেছে।
২০২২ সালে পাকিস্তান প্রথম এই যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করে এবং ২০২৫ সালে ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষে তা ব্যবহার করে। পাকিস্তানের জিও নিউজ জানায়, এই সংঘাতে জে-১০সি এর সাফল্য চীনের অস্ত্র রপ্তানি খাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
আধুনিক ডিজাইন ও প্রযুক্তির সমন্বয়
চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত চেংদু এয়ারক্রাফট কর্পোরেশন নির্মিত জে-১০সি একটি মাঝারি ওজনের, একক ইঞ্জিনবিশিষ্ট মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান। মূলত আকাশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও আকাশ থেকে ভূমিতে আঘাত হানার জন্য এটি তৈরি। এর ডিজাইনে রয়েছে ক্যানার্ড-ডেল্টা উইং স্ট্রাকচার, যা বিমানটির গতি ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বাড়ায়।
জে-১০সি তে রয়েছে ১১টি অস্ত্র বহন পয়েন্ট, যেখানে যুদ্ধবিমানের বডি ও ডানায় মিলে বিপুল পরিমাণ ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা বহন সম্ভব। এই বিমানে চীনা পিএল-৮, পিএল-১২, পিএল-১৫ এর পাশাপাশি রাশিয়ান R-73 ও R-77 মিসাইল ব্যবহার করা যায়। একযোগে এটি ৬টি ৫০০ কেজি ওজনের বোমা বহনে সক্ষম এবং একটি ২৩ মিমি কামানও এতে অন্তর্ভুক্ত।
অত্যাধুনিক সেন্সর ও রাডার প্রযুক্তি
জে-১০সি এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য AESA রাডার, যা প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূর থেকে ১০টি লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত ও ৪টিকে একযোগে আঘাত করতে সক্ষম। ইলেকট্রনিক ওয়্যারফেয়ার ও লেজার-গাইডেড টার্গেটিং পড প্রযুক্তির মাধ্যমে এটি শত্রুর রাডার থেকে নিজেকে লুকিয়ে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে পারে।
পুরনো সংস্করণগুলোর তুলনায় জে-১০সি তে ব্যবহৃত হয়েছে চীনের নিজস্ব উন্নত ইঞ্জিন WS-10B, যা আগের রাশিয়ান AL-31 ইঞ্জিনের তুলনায় অধিক কার্যকর।
রণাঙ্গনে জে-১০সি এর প্রথম ব্যবহার
২০২৫ সালের ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে জে-১০সি এর যুদ্ধাঙ্গনে অভিষেক ঘটে। ভারতীয় রাফাল ফাইটারের মুখোমুখি হয়ে পাকিস্তানের জে-১০সি সফলভাবে পাল্টা আঘাত হানে এবং ভারতের ভূপাতিত ৫টি যুদ্ধবিমানের মধ্যে ৩টিই ছিল রাফাল। পাকিস্তানের বিমানবাহিনী থেকে জানা যায়, হামলায় মোট ১২৫টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয়, যার মধ্যে জে-১০সি ছিল অগ্রভাগে।
সংঘাতকালীন ভারতের ৪টি রাফাল জেট পালিয়ে যায় পাকিস্তানের জে-১০সি দেখে— এমন দাবি করে পাকিস্তানি সামরিক সূত্র। সংঘর্ষের পরপরই ফরাসি নির্মাতা দাসোর শেয়ারের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
চীনের বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বাজার বিস্তার
চীনের এই সামরিক সাফল্য বিশ্ব অস্ত্রবাজারে তার অবস্থান আরও শক্তিশালী করেছে। ২০২৪ সালের দুবাই এয়ার শো-তে চীনের "আগস্ট ফার্স্ট অ্যারোবেটিক্স টিম" প্রথমবারের মতো জে-১০সি প্রদর্শন করে, যা ছিল এর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আত্মপ্রকাশের সূচনা।
চীনের এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে। মিসর, আলজেরিয়া ও সৌদি আরব ইতোমধ্যে চীনের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র কিনছে, এবং এখন জে-১০সি কে সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করছে।
পাকিস্তানের সামরিক নির্ভরতা
বর্তমানে পাকিস্তানের ৮০ শতাংশ সামরিক সরঞ্জাম আসে চীন থেকে। জে-১০সি অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে দেশটির বিমানবাহিনী উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী হয়েছে। ২০২০ সালে পাকিস্তান প্রথম ২৫টি জে-১০সি অর্ডার করে এবং পরে আরও ১১টি যুক্ত করে। এখন পর্যন্ত ২০টি ফাইটার পাকিস্তানের হাতে এসেছে।
‘নকল’ থেকে নিজস্বতায় রূপান্তর
জে-১০সি এর ডিজাইনে মিরাজ বা এফ-১৬ এর প্রভাব থাকলেও, এখন এটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ একটি উন্নত যুদ্ধবিমান। ক্যানার্ড ডিজাইন, নিজস্ব ইঞ্জিন, উন্নত রাডার এবং অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবস্থার মাধ্যমে জে-১০সি নিজস্ব পরিচয় তৈরি করেছে— এটি আর ‘অনুকরণ’ নয়, বরং আধুনিক চীনা সামরিক প্রযুক্তির প্রতিচ্ছবি।