
বাঁধ
দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সিচুয়ান প্রদেশে নির্মাণাধীন শুয়াংজিয়াংকৌ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে পানি সংরক্ষণ শুরু হয়েছে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন অভ চায়না (পাওয়ারচায়না) জানিয়েছে, ১ মে থেকে বাঁধটিতে প্রথম ধাপের পানি সংরক্ষণ শুরু হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ হলে হবে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু বাঁধ — যার উচ্চতা হবে ৩১৫ মিটার (১,০৩৩ ফুট), অর্থাৎ ১০০ তলার চেয়েও বেশি একটি ভবনের সমান।
প্রায় এক দশক ধরে নির্মাণাধীন এই প্রকল্পটি অবস্থিত সিচুয়ানের আবা তিব্বত ও কিয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৬ বিলিয়ন ইউয়ান বা প্রায় ৪.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাঁধটি দাদু নদীর উজানে নির্মিত হচ্ছে, যেটি পূর্ব তিব্বত মালভূমি থেকে সিচুয়ান অববাহিকায় প্রবাহিত।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ
শুয়াংজিয়াংকৌ প্রকল্পটির লক্ষ্য হলো বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ। পুরোদমে চালু হলে এর উৎপাদন ক্ষমতা হবে ২ হাজার মেগাওয়াট এবং এটি বছরে ৭ বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ ৩ মিলিয়নেরও বেশি পরিবারের বার্ষিক চাহিদা পূরণে সক্ষম।
পাওয়ারচায়নার মতে, এটি বছরে ২.৯৬ মিলিয়ন টন কয়লার ব্যবহার প্রতিস্থাপন করবে এবং ৭.১৮ মিলিয়ন টন কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন হ্রাস করবে।
রেকর্ড ভাঙা বাঁধ
বাঁধটি সিচুয়ানে অবস্থিত বিদ্যমান জিনপিং-১ বাঁধের চেয়েও ১০ মিটার বেশি উঁচু হবে, যেটি বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ বাঁধ হিসেবে পরিচিত। পানি সংরক্ষণের প্রথম ধাপে এর পৃষ্ঠের উচ্চতা ২,৩৪৪ মিটার পর্যন্ত পৌঁছেছে, যা নদীর প্রাকৃতিক পানির পৃষ্ঠের চেয়ে প্রায় ৮০ মিটার উঁচু।
এটির মোট পানি ধারণক্ষমতা ১১০ মিলিয়ন ঘনমিটার, যা হাংঝুর বিখ্যাত ওয়েস্ট লেকের পানির চেয়ে প্রায় আটগুণ বেশি।
প্রযুক্তি ও প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জ
প্রকল্পটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,৪০০ মিটার উঁচুতে এবং ভূতাত্ত্বিকভাবে জটিল অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় নির্মাণকাজ ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। ২০১৬ সালে প্রকল্পের দুইজন সিনিয়র প্রকৌশলী এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন, সিপেজ নিয়ন্ত্রণ, ভূমিকম্প প্রতিরোধ, এবং সঠিক পানি নিষ্কাশনের মতো জটিল প্রযুক্তিগত বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে।
এই সমস্যাগুলোর সমাধানে রোবোটিক্স ও ফাইভজি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। সেন্সরযুক্ত রোবোটিক রোলার দিয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ পরিচালিত হয়েছে, এবং ড্রোনের মাধ্যমে পরিবেশগত ঝুঁকি শনাক্ত করা হয়েছে।
পরিবেশগত উদ্বেগ ও উদ্যোগ
যদিও এই প্রকল্প পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উৎপাদনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে, তবে এটি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। চীন এর আগেও বাঁধ নির্মাণের কারণে এক মিলিয়নের বেশি মানুষকে স্থানচ্যুত করেছে এবং বহু প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক স্থাপনার ক্ষতি হয়েছে।
শুয়াংজিয়াংকৌ প্রকল্পে এ ধরণের প্রভাব হ্রাস করতে নেওয়া হয়েছে কিছু উদ্যোগ, যার মধ্যে একটি বিশেষ উদ্ভিদ উদ্যান গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে সংরক্ষিত গাছপালা স্থানান্তর করে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
চীনের বাঁধ নির্মাণে আধিপত্য
চীন বিশ্বে বাঁধ নির্মাণে শীর্ষে রয়েছে। ১৫ মিটার উচ্চতার বেশি প্রায় ২২ হাজার বাঁধ দেশটিতে রয়েছে, যা বিশ্বের মোট বাঁধের প্রায় অর্ধেক। এদের মধ্যে অধিকাংশই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত এবং মূলত জলবিদ্যুৎ, সেচ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হয়।
শুয়াংজিয়াংকৌ বাঁধের মাধ্যমে চীন শুধু একটি প্রযুক্তিগত কৃতিত্ব অর্জন করতে যাচ্ছে না, বরং এটি তাদের পরিবেশবান্ধব জ্বালানির লক্ষ্যপূরণের পথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।