মধ্যপ্রাচ্যের সর্বত্রই কেফিয়াহ পরার রীতি থাকলেও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে কেফিয়াহকে ফিলিস্তিনিদের জাতীয় পরিচয় ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি ইসরায়েল এবং হামাস যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনের স্বপক্ষে বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভকারীদের গলায় এই কেফিয়াহ স্কার্ফ দেখা গেছে। কেউ কেউ এটিকে মুখ ঢেকে রাখতেও ব্যবহার করেছেন।
ফিলিস্তিনি-কানাডিয়ান সাংবাদিক মজিদ মালহাস জানান, আরবে এই কেফিয়াহ যাযাবর বেদুইন, কৃষক এবং রাখালরা পরে বহু যুগ ধরেই। কিন্তু এখন এই কেফিয়াহই বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিকতাবাদ-বিরোধী অনেক বিপ্লবী ও কর্মীদের কাছে একটি আইকনিক পোশাক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কেফিয়াহকে ইংরেজিতে বলা হয় কুফিয়া বা কাফিয়াহ। ঐতিহ্যবাহী স্কার্ফ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব অঞ্চলেই প্রতিদিন ব্যবহার হয়ে থাকে। বেশিরভাগ কেফিয়াহ সাদা-কালো বা লাল-সাদা'র। তবে সুতার ব্যবহার বিভিন্ন প্যাটার্নের হয়।
ফিলিস্তিনের পোশাক বিশেষজ্ঞ ও গবেষক ওয়াফা ঘনাইম সিএনএনকে বলেন, ১৯২০ সাল পর্যন্ত কেফিয়াহকে হাত্তা বা শামাঘ বলা হতো যা ফিলিস্তিনের বেশিরভাগ যাযাবর বেদুইন পুরুষরা এটি পরতেন। উনিশ শতকের দিকে কেফিয়াহ সাধারণত তুলা, সিল্ক এবং সূক্ষ্ম উল দিয়ে তৈরি করা হতো।
ঘনাইম আরও বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে পুরুষ কিংবা মহিলা সবাই হেডড্রেস পরে। বেদুইনদের তুলনায় গ্রাম এবং শহরে বসবাসকারী লোকদের হেডড্রেসের ধরন আলাদা-আলাদা ছিল। বেদুইনরা কেফিয়াহকে আড়াআড়িভাবে ভাঁজ করে মাথায় পরতো এবং মাথায় সুরক্ষিতভাবে রাখার জন্য একটি রজ্জুও ব্যবহার করত।
সাদা এবং কালো কেফিয়াহ জর্ডানের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করা হয়, কারণ ব্রিটিশ কমান্ডাররা ডেজার্ট প্যাট্রোলের সময় ইউনিফর্মের অংশ হিসেবে এটিকে ব্যবহার করতো। ফিলিস্তিনিরা এবং প্রতিরোধ যোদ্ধারা সব রঙের কেফিয়াহ পরেছে।
বিশ্বের অনেক ফিলিস্তিনি এবং আরব বংশোদ্ভূত মানুষেরা ভাবেন যে, কেফিয়াহ তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিরই একটি অংশ। ফিলিস্তিনের ব্র্যান্ড কৌশলবিদ ও ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ডালিয়া জ্যাকব বলেন, যখন তিনি বাইরের কোনো দেশ ভ্রমণে যান, তখন তার শহর হেব্রনের তৈরি করা কেফিয়াহ পরেন।
তিনি আরও বলেন, এই স্কার্ফ প্রতিরোধ এবং শান্তির প্রতীক। যখন আমি কেফিয়াহ পরে কোথাও ঘুরতে বের হই, তখন মনে হয় সেই জায়গাতে নিজের ঠিকানাকে সঙ্গে বহন করে নিয়ে যাচ্ছি।
সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক ছাড়াও কেফিয়াহ এখন রাজনীতিতে যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা। কিছুটা সাংস্কৃতিক কিংবা ধর্মীয় ঐতিহ্য এবং জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিশে থাকা অন্যান্য পোশাকের মতোই।
গবেষক ঘনাইমের মতে, ১৯৩৬-১৯৩৯ সালের দিকে আরব বিদ্রোহের সময়, ফিলিস্তিনিরা যখন ব্রিটিশ দখলদারিত্বের অবসান ঘুচিয়ে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, তখন শান্তি এবং সংহতির প্রতীক হিসেবে সাদা-কালো কেফিয়াহ তারা পরেছিল।
১৯৬০-এর দশকে রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে কেফিয়ার আরও এক পুনরুত্থান ঘটে। আর ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশনের প্রধান ইয়াসির আরাফাতকে প্রায়ই সাদা এবং কালো কেফিয়াহ পরতে দেখা গেছে। যা ফিলিস্তিনের জাতীয় সংগ্রামকে নির্দেশ করত সেই সময়।
প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের একজন সাবেক কর্মী ও যোদ্ধা লায়লা খালেদ ১৯৬৯ সালের দিকে বিমান ছিনতাইয়ের জন্য ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তিনিও ফিলিস্তিনের জাতীয় সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে মাথায় এবং গলায় কেফিয়াহ জুড়িয়ে রাখতেন।