ঢাকা,  শনিবার
২৭ জুলাই ২০২৪

Advertisement
Advertisement

শাহিনের হাত-পা কেটে ফেলতে ২০ হাজার টাকা দেন সাবেক এমপি আউয়াল

প্রকাশিত: ১০:০১, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

আপডেট: ১৬:৪৭, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

শাহিনের হাত-পা কেটে ফেলতে ২০ হাজার টাকা দেন সাবেক এমপি  আউয়াল

শাহিনের হাত-পা কেটে ফেলতে ২০ হাজার টাকা দেন সাবেক এমপি আউয়াল

রাজধানীর পল্লবীতে ব্যবসায়ী মো. শাহিন উদ্দিনকে সাত বছর বয়সী ছেলের সামনে দিনদুপুরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় গত ২০২১ সালের ১৬ মে। এ ঘটনায় সেদিন রাতেই নিহত শাহিনের মা আকলিমা বেগম বাদী হয়ে পল্লবী থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় লক্ষ্মীপুর- আসনের সাবেক এমপি ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এম আউয়ালকে প্রধান আসামি করে ২০ জনকে আসামি করা হয়।  আউয়ালসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেছে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)

রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) পল্লবী থানার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখায় সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই পুলিশের পরিদর্শক মনির হোসেন। আগামী ১২ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করেছেন আদালত।

চার্জশিট সূত্রে জানা গেছে, ব্যবসায়ী শাহিন উদ্দিনের হাত-পা কেটে ফেলার জন্য প্রাথমিক খরচ বাবদ আসামি সুমন বেপারীকে ২০ হাজার টাকা দেন এম আউয়াল। এরপর আসামি সুমন টিটি শেখ ওরফে টিটু হত্যার বিষয়ে আলোচনা করেন। পরে অন্য আসামিদের সহযোগিতায় শাহিনকে তার সাত বছর বয়সী সন্তানের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পুলিশের পরিদর্শক মনির হোসেন জানান, পল্লবীতে শাহিন উদ্দিন হত্যা মামলায় তদন্তে সত্যতা পেয়ে সাবেক এমপি এম আউয়ালসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেছি।

আরও পড়ুন: পুরনো মোবাইল সিম দিয়ে চলছে প্রতারণা

এ মামলায় এম আউয়াল ছাড়াও চার্জশিটভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন তাহের, সুমন বেপারী, মুরাদ, টিটি শেখ ওরফে টিটু, গোলাম কিবরিয়া খান, ইব্রাহিম সুমন ওরফে বাওয়া সুমন, শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিক, রকি তালুকদার ওরফে রকি, নুর মোহাম্মদ হাসান মোতাইত, ইকবাল হোসেন ওরফে ইতবাল নুর, শরিফ, তৌরিকুল ইসলাম ওরফে ইমন, তুহিন মিয়া, হারুন অর রশীদ ওরফে হারুন প্রতীক আহম্মেদ সজীব।

মামলার বাদী আকলিমা বেগম জানান, আমার ছেলের সঙ্গে আমাদের আত্মীয় মনোয়ার হোসেন সুমনের ভেজাল ছিল। সে তাকে হত্যা করিয়েছে। ডিবি পিবিআইকে সুমনের নাম যুক্ত করার জন্য বলা হলেও তা করা হয়নি। আইন চলে টাকা পায়সায়। আসামিরা আমাদের এখনো হুমকি দিচ্ছেন। বাড়িঘর ভাঙচুর করছেন। আমরা এখনো নিরাপদ নই। পিবিআই যে চার্জশিটটা দিয়েছে তার বিরুদ্ধে নারাজি দেবো।

মামলার চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, রাজধানীর মিরপুরে আলীনগর আবাসিক প্রকল্পের পিলার ভেঙে ফেলায় এম আওয়াল ভিকটিম শাহিনের ওপর ক্ষুব্ধ হন। এরপর তার কোম্পানির পিডি আসামি মোহাম্মদ তাহেরকে দিয়ে মাইনুউদ্দিন শাহিনের নামে ২০২১ সালের ২৭ এপ্রিল পল্লবী থানায় মামলা করান। পুলিশ ওই মামলায় মাইনুউদ্দিন শাহিনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায়। শাহিন কারাগারে থাকা অবস্থায় তার স্ত্রীর বড় ভাই জহির হাভেলি প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের পক্ষে আসামি সুমন বেপারী টিটুকে সঙ্গে নিয়ে মেজর (অব.) মোস্তফা কামালের জমির অর্ধেক বাউন্ডারি দেওয়াল ভেঙে ফেলে। শাহিন মাইনুউদ্দিন বেশ কিছুদিন পর জেল থেকে জামিনে বের হয়ে ফের ওই আবাসিক প্রকল্পের ১০ কাঠা জমির বাউন্ডারি দেওয়াল ভেঙে ফেলেন। ফলে পিএস সজীব কোম্পানির হয়ে সুমন টিটুকে অফিসে যেতে বলে। ঈদের / দিন আগে আসামি এম আওয়ালের অফিসে বেতন আনতে যান সুমন টিটু। সেখানে আসামি মোহাম্মদ তাহের, সাইট ম্যানেজার গোলাম কিবরিয়া খান, জহির সজীবদের আওয়ালের রুমে একসঙ্গে বসা অবস্থায় দেখতে পান শাহিন। এসময় এমএ আওয়াল উপস্থিত থেকে সুমন, টিটু এবং শাহিনের মধ্যে বিরোধের বিষয়টি সবার উপস্থিতিতে মীমাংসা করে দেন। পরে ঈদের বেতন-ভাতা বাবদ কোম্পানির পক্ষে সবাইকে টাকা দেন সজীব।

আরও পড়ুন: মসজিদে গেলেই মুসল্লিদের স্বাগত জানানো হয় সুগন্ধী-কাপড় দিয়ে!

যেভাবে হত্যা করা হয়

পিবিআইয়ের চার্জশিটে বলা হয়েছে, শাহিনের হাত-পা কেটে ফেলার জন্য খরচ বাবদ সুমনকে ২০ হাজার টাকা দেন আওয়াল। সুমন টিটু অফিস থেকে বের হয়ে শাহিনকে হত্যার বিষয়ে আলোচনা করেন। এরপর ইটের টাকা নিতে শাহিনকে ডাকার জন্য সুমনকে পরামর্শ দেন টিটু। সে পরিকল্পনায় ১৬ মে সকালে সুমন হত্যা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে লোকজন ঠিক করেন। আসামি মানিক, মুরাদ, ইকবাল হোসেন, নূর মোহাম্মদ হাসান মোতাইত রকিকে মোবাইল ফোনে ডেকে আনেন। শাহিনকে হত্যার জন্য সুমন মোবাইল ফোনে রকিকে / জন লোক দিতে বলেন। রকি তখন বাউনিয়াবাদের আসামি শফিককে / জন লোক জোগাড় করে দিতে বলেন। সে অনুযায়ী শফিক দুপুর ১২টার দিকে আসামি শরিফ ইমন, তুহিন হারুনদের নিয়ে লালডেক ঈদগাহ মাঠে রকির সঙ্গে দেখা করতে বলেন। শফিকের কথামত শরীফ তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে প্রথমে ইমনকে ফোন করে দেখা করতে বলেন। এরপর আসামি ইমন দুপুর আনুমানিক আড়াইটার দিকে লালমাটিয়া নম্বর রোডে শরীফের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে শরীফের সঙ্গে শফিকও উপস্থিত ছিলেন। শফিক আসামি হারুন তুহিনদের সঙ্গে নিয়ে লালডেক ঈদগাহ মাঠে দেখা করতে বলে সেখান থেকে চলে যান।

এরপর আসামি শরীফ ইমন মিলে আসামি হারুনের বাসায় যান। তার আগে শরীফ তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে হারুনকে ঘর হতে বের হতে বলেন। হারুন ঘর হতে বের হলে শরীফ, ইমন হারুন মিলে লালডেক ঈদগাহ মাঠে যান। এরপর ইমনের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তুহিনকে দ্রুত লালডেক ঈদগাহ মাঠে আসতে বলেন শরীফ। তুহিন তখন মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ছিলেন। তুহিন লালডেক ঈদগাহ মাঠে পৌঁছালে সেখানে তার বন্ধু শরীফ, ইমন, হারুন, শফিক রকিদের দেখতে পান। এরপর শফিক তাদের রকির সঙ্গে যেতে বলেন। তখন তারা রকির সঙ্গে পল্লবী থানাধীন সেকশন ১২, ব্লক-ডি, ৩১ নম্বর রোডে যায়। সেখানে গিয়ে রকি সুমনের সঙ্গে দেখা করলে সুমন তাদের চায়ের দোকানে বসতে বলেন। রকি তার সঙ্গে থাকা আসামিদের সুমনের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যান। রকি চলে যাওয়ার আগে সুমনের কাছে কাজ বাবদ ১০ হাজার টাকা চান। সুমনও টাকা দিতে রাজি হন।

মামলার চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেন, আসামি সুমন চায়ের দোকানে বসে থাকা চারজনের মধ্যে আসামি তুহিনকে ডেকে নিয়ে কথা বলেন এবং সঙ্গে কিছু এনেছে কি না জিজ্ঞেস করেন। তুহিনকিছু নাইজানালে শরীফ, ইমন, হারুন, তুহিনদের চায়ের দোকানে অপেক্ষা করতে বলেন সুমন। এর কিছুক্ষণ পর সুমন তাদের ডেকে ৩১ নম্বর রোডে নিয়ে যান। শরীফ হারুনকে ৪০ নম্বর বাড়ির কোণায় এবং আসামি ইমন তুহিনকে ৪০ নম্বর বাডড়ির বিপরীত পাশের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দেন সুমন। তখন তিনি শরীফের হাতে একটি রাম দা, হারুনের হাতে একটি দা, তুহিনের হাতে একটি বড় ছুরি ইমনের হাতে একটি রাম দা তুলে দেন। সুমন তাদের বলেন, তার কাছে একজন লোক আসবে। তিনি যে লোকটার পিঠে হাত দেবেন সে লোকটাকে কোপাতে হবে। তার কথামতো সবাই যার যার অবস্থান নেন এবং হাতে থাকা ধারালো অস্ত্র লুকিয়ে রাখেন। আসামি টিটু তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকলেও তার কথামতো সুমন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন।

চার্জশেটে উল্লেখ করা হয়, কোপ খেয়ে শাহিন মোটরসাইকেল থেকে মাটিতে পড়ে যান এবং আত্মরক্ষার জন্য ৪০ নম্বর বাড়ির গ্যারেজের ভেতর ঢুকে পড়েন। কিন্তু সেখানে আগে থেকে ওঁত পেতে ছিলেন আসামি মানিক মুরাদ। শাহিন গ্যারেজে ঢোকার পর সুমন সেখানে যান। এসময় মুরাদ চাপাতি দিয়ে, আর মানিক বড় ছুরি দিয়ে এবং সুমন রামদা দিয়ে গ্যারেজের ভেতর শাহিনের ডান হাতে, ডান পায়ে বুকে কোপাতে থাকেন। প্রাণে বাঁচতে শাহিন চিৎকার করতে করতে গ্যারেজের ভেতর থেকে বের হয়ে আসেন।

আরও পড়ুন: মোবাইলের স্ক্রিনে কোরআনের আয়াত ব্যবহার, ইসলাম কি বলে?

তখন আসামি মোহাম্মদ হাসান মোতাহত, ইকবাল হোসেন মনির দৌড়ে ৪০ নম্বর বাসার সামনে চলে যান এবং আসামিরা মিলে শাহিনকে ঘিরে ফেলেন। এরপর সবাই যার যার হাতে থাকা অস্ত্র দিয়ে শাহিনকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। এসময় ৩৬ নম্বর বাড়ির সামনে নিস্তেজ হয়ে মাটিতে পড়ে যান শাহিন। তখন সুমন রাম দা দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা ভিকটিমের মাথায় সজোরে কোপ দেন। আসামি মনির বড় ছুরি ধরে শাহিনের ঘাড়ে, মাথার পেছনে ডান হাতে কোপান এবং আসামি মানিক দুই হাত দিয়ে বড় ছুরি ধরে শাহিনের বাম হাঁটু থেকে বাম পায়ের পাতাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কুপিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন।

এর আগে ২০২২ সালের ১২ মে আদালত শাহিন উদ্দিনের মায়ের নারাজির আবেদন গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে পিবিআইকে মামলাটি পুনরায় তদন্ত করে প্রতিবেদন জমার নির্দেশ দেন। এর আগে ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে মামলায় এম আউয়ালসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক সৈয়দ ইফতেখার হোসেন।

অন্য আসামিরা হলেন, সুমন ব্যাপারী, টিটু, কিবরিয়া, মুরাদ হোসেন, আবু তাহের, ইব্রাহিম সুমন, রকি তালুকদার, শফিকুল ইসলাম, তুহিন মিয়া, হারুন অর রশীদ, তারিকুল ইসলাম, নুর মোহাম্মদ, হাসান ইকবাল হোসেন। সুমন শফিকুল ছাড়া বাকি ১৩ আসামি কারাগারে। তাদের মধ্যে জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

Advertisement
Advertisement

Notice: Undefined variable: sAddThis in /mnt/volume_sgp1_05/p1kq0rsou/public_html/details.php on line 531