সিগারেট
চট্টগ্রাম হয়ে উঠেছে দেশের অবৈধ সিগারেট চক্রের মূল কেন্দ্র। বন্দরনগরীর আনোয়ারা উপজেলার দোভাষী বাজারে সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বাজারজুড়ে প্রকাশ্যেই অবৈধভাবে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট।
দোকানের তাকজুড়ে সাজানো রয়েছে টি২০, মার্বেল, পুরবি, এক্সপ্রেস, মার্বেল ও ওসাকা সিগারেট। এসব সিগারেট প্রতি প্যাকেট মাত্র ৪৫ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা সরকার-নির্ধারিত ন্যূনতম খুচরা মূল্যের চেয়ে অনেক কম।
দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব সিগারেটের প্রতিটি খালি প্যাকেট ফেরত দিলে পাওয়া যায় ৫ টাকা করে ক্যাশব্যাক। এই কৌশলের কারণে খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে সেগুলোর চাহিদা দ্রুত বাড়ছে।
স্থানীয়রা বলছেন, প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় এসব অবৈধ সিগারেট এখন সহজলভ্য হয়ে উঠেছে এবং এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
চট্টগ্রামের বন্দর, বিমানবন্দর ও সীমান্তবর্তী অবস্থানের সুবিধা কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধ আমদানি, চোরাচালান ও নকল সিগারেট উৎপাদনের এক বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে।
চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার, খাতুনগঞ্জ, চকবাজার ও লালখান বাজার থেকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ সিগারেট দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাইকারি ও খুচরা বাজারে বিতরণ করা হচ্ছে।
বেসরকারি বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনসাইড মেট্রিক্স-এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের বাজারের প্রায় ১৩.১ শতাংশ সিগারেট অবৈধভাবে প্রবেশ করছে—যা গত বছরের তুলনায় ৩১ শতাংশ বেশি। প্রতি মাসে প্রায় ৮৩ কোটি ২০ লাখ শলাকা অবৈধ সিগারেট দেশের বাজারে প্রবেশ করছে। ফলে বৈধ ব্র্যান্ডের বিক্রি কমছে এবং সরকারের রাজস্বে বছরে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
এছাড়া স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত নকল সিগারেটের সংখ্যাও বাড়ছে। উৎপাদকারীরা ট্যাক্স স্ট্যাম্প পুনর্ব্যবহার করছে; তারা বৈধ সিগারেটের প্যাকেট থেকে এগুলো খুলে নিয়ে অবৈধ পণ্যে যুক্ত করছে। এর ফলে তারা কর পরিশোধ না করেও বাজারে বৈধ পণ্যের মতো অবৈধ সিগারেট বিক্রি করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অবৈধ ব্যবসা শুধু রাজস্বের ক্ষতি করছে না, জনস্বাস্থ্যের জন্যও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কম দামের কারণে তরুণ ও নিম্ন-আয়ের মানুষ এসব সিগারেট বেশি ব্যবহার করছে।
ভুয়া ঘোষণা ও চোরাচালানের গোপন পথ
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কসমেটিকস, প্লাস্টিক পণ্য, আসবাবপত্র এমনকি কমলালেবুর ঘোষণার আড়ালে কোটি কোটি টাকার সিগারেট আমদানি করা হচ্ছে।
স্থানীয়ভাবে তৈরি নকল সিগারেট কারখানা মহেশখালী, আনোয়ারা, রাউজান ও নগরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে আছে। বৈধ পণ্যে ব্যবহৃত ট্যাক্স ব্যান্ড এসব কারখানায় পুনর্ব্যবহার করে নকল সিগারেট বাজারজাত করা হয়। বিশেষ করে রিয়াজউদ্দিন বাজার অবৈধ সিগারেটের মূল ট্রানজিট হাব হিসেবে কাজ করছে; এখান থেকে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাইকারি চালান পাঠানো হয়।
চট্টগ্রামের অবৈধ সিগারেট ব্যবসায়ীরা খুচরা বিক্রেতাদের জন্য বিশেষ ক্যাশব্যাক অফার, কম দামে বিক্রি ও ভুয়া প্যাকেট ব্যবহার করে বৈধ বাজারে আধিপত্য বিস্তার করছে। ফলে অনেক ভোক্তা বৈধ সিগারেটের পরিবর্তে সস্তা অবৈধ সিগারেটের দিকে ঝুঁকছে।
রিয়াজুদ্দিন বাজারে কথা হয় এক সিগারেট দোকানের একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'অবৈধ উপায়ে সমুদ্রপথে এবং বিমানবন্দরের মাধ্যমে এসব সিগারেট দেশে আনা হয়। পরে রিয়াজুদ্দীন বাজার ও খাতুনগঞ্জ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে।'
নগরীর ২ নম্বর গেট এলাকার একজন খুচরা বিক্রেতা বলেন, দেশি সিগারেটের চেয়ে বিদেশি ব্র্যান্ডের চাহিদা এখন অনেক বেশি। কীভাবে এসব সিগারেট তাদের হাতে আসে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'নির্দিষ্ট কিছু লোক আছে, ফোন করলেই তারা দোকানে পৌঁছে দেয়। এছাড়া রিয়াজুদ্দিন বাজারের পাইকারি দোকানেও এসব সিগারেট সহজে পাওয়া যায়।'
যা বলছে প্রশাসন
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) সৈয়দ মাহবুবুল হক বলেন, 'অবৈধ সিগারেট শুধু রাজস্ব ক্ষতির কারণ নয়, এটি জনস্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক হুমকি। এসব পণ্যে কোনো মান নিয়ন্ত্রণ নেই। আমরা বিষয়টি ভ্যাট ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে অবহিত করব।'
চট্টগ্রাম কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার মো. তারেক মাহমুদ বলেন, 'চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ কনটেইনার আসে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এই সুযোগে ভুয়া ঘোষণার আড়ালে অবৈধ পণ্য আনার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে বড় বড় অভিযানে অবৈধ সিগারেট জব্দ করা হয়েছে।
'কর্মকর্তাদের সতর্ক করা হয়েছে এবং স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট, কাস্টমস ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।'
কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের যুগ্ম-পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, 'আমাদের হাতে যে তথ্য রয়েছে, তার ভিত্তিতে সব জায়গায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।'
তবে প্রশাসনের তৎপরতা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম হয়ে দেশের বাজারে নিয়মিত প্রবেশ করছে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সিগারেট। গত কয়েক বছরে একের পর এক অভিযানে উঠে এসেছে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ ও আন্তর্জাতিক চোরাচালানচক্রের সক্রিয়তার ইঙ্গিত।
গত আগস্টে চট্টগ্রাম বন্দরে ধরা পড়ে ১৩৭ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির একটি চালান, যেখানে 'কাগজের চালান' দেখিয়ে মূলত সিগারেট পেপার আমদানি করা হয়েছিল।
এছাড়া ২৮ জুলাই সীতাকুণ্ডের জোড়ামতল এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রশাসন জব্দ করে ১০ লাখ টাকার এক্সপ্রেস ব্র্যান্ডের লোগোসম্বলিত অবৈধ সিগারেট। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পরিচালিত ওই অভিযানে নেতৃত্ব দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফখরুল ইসলাম।
২০২৪ সালের অক্টোবরে হালিশহর ও নয়াবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে কাস্টমস গোয়েন্দা ও ভ্যাট কর্মকর্তারা বিপুল পরিমাণ বিদেশি সিগারেট পেপার ও অবৈধ সিগারেট স্ট্যাম্প জব্দ করেন। এই ঘটনায় আওয়ামী লীগের সাবেক কাউন্সিলর আবদুস সবুর লিটন ও তার ভাই আব্দুল মান্নান খোকনের নাম উঠে আসে।



.png)
.png)