বাংলাদেশ সীমান্ত
জুলাইয়ের প্রথম দিকের এক সকালে ভারতের লখনৌয়ের ২৪ বছর বয়সি মুসলিম যুবক শিবু সৈয়দ জাফরিকে দিল্লির একটি বস্তিতে বিছানা থেকে টেনে তোলে পুলিশ। এরপর হাত-চোখ বেঁধে তাকে তুলে দেওয়া হয় উড়োজাহাজে। এভাবেই শুরু হয় তার সেই যাত্রা, যার সমাপ্তি ঘটে বন্দুকের নলের মুখে জোরপূর্বক বাংলাদেশ সীমান্তে পার করে দেওয়ার মাধ্যমে। ঢাকার আদালতে এভাবেই নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন শিবু।
গত ২১ অক্টোবর ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসেনের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে শিবু বলেন, ভারতীয় কর্মকর্তারা তার হাত পেছনে বেঁধে, চোখ কাপড়ে ঢেকে কলকাতার একটি ফ্লাইটে তুলে দেন।
শিবু বলেন, তিন দিন ধরে তাকে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানোর পর একটি সীমান্ত এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্মকর্তারা তার চোখের বাঁধন খুলে বন্দুকের নলের মুখে 'ফসলি জমিতে দৌড় দিতে' নির্দেশ দেন।
শিবু বলেন, তিনি কোনো বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষীর মুখোমুখি না হয়েই সীমান্ত পার হন এবং কোনোভাবে ঢাকায় চলে আসেন। এখানে ১৫ জুলাই কমলাপুর কাস্টমস হাউসের সামনে থেকে পুলিশ তাকে আটক করে।
যেভাবে পুলিশ তাকে পেল
মামলার এজাহার অনুযায়ী, শাহজাহানপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নূর নবী সেদিন সন্ধ্যায় জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর মাধ্যমে একটি কল পান। স্থানীয়রা এমন একজনকে ঘিরে ধরেছিল, যিনি 'বাংলা বলতে পারেন না', তাকে বিদেশি নাগরিক বলে মনে হচ্ছে।
নূর নবী লিখেছেন, 'আমি ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই লোকজন তাকে ধরে ফেলেছিল। তিনি হিন্দিতে সাহায্য চাইছিলেন। পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ ছিল।' শিবু হিন্দিতে নিজের পরিচয় দেন এবং বলেন যে তিনি লখনৌয়ের আমীর নগরের বাসিন্দা।
তিনি পুলিশকে জানান, তাকে দিল্লি থেকে জোর করে ধরে বিমানে তুলে দেওয়া হয়, এরপর হাত-চোখ বেঁধে সীমান্তে নিয়ে এসে তাকে বাংলাদেশে পুশ-ইন করে দেওয়া হয়। এরপর তিনি কয়েকদিন কমলাপুর এলাকায় ঘোরাঘুরি করেন।
পুলিশ প্রথমে তাকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় আটক করে। পরে ১২ আগস্ট অবৈধ প্রবেশের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়।
যোগাযোগের প্রতিবন্ধকতা
শিবু বাংলা বা ইংরেজি কোনোটিই বলতে পারেন না।
তার আদালত-নিযুক্ত আইনজীবী, ঢাকা জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের প্যানেল আইনজীবী হাকিম বাহাউল হক সাইমনের সহায়তায় তার জবানবন্দি হিন্দিতে রেকর্ড করা হয়েছে।
তবে শিবুর হিন্দির মধ্যে এমন আঞ্চলিকতা রয়েছে যে, যারা হিন্দিভাষী নন তাদের পক্ষে তাকে বোঝা কঠিন।
হাকিম বলেন, 'সবচেয়ে বড় বাধা ছিল যোগাযোগ। সীমান্ত থেকে কীভাবে কমলাপুরে পৌঁছেছেন, তা তিনি ব্যাখ্যা করতে পারেননি। তবে আমরা তাকে লখনৌতে তার পরিবারের সাথে পুনর্মিলিত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।'
নূর নবী আদালতকে বলেন, তিনি কয়েকদিন ধরে সীমান্ত থেকে শিবুর আসার পথ বোঝার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, এরপর মামলাটি অন্য একজন হিন্দি ভাষা জানা উপ-পরিদর্শকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে শিবুর বয়স ৩০ বছর বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
স্বীকারোক্তিতে যা বলা হয়েছে
আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে শিবু জানান, তার পুরো নাম শিবু সৈয়দ জাফরি, বাবা-মায়ের নাম যথাক্রমে মোফিদ ও শায়েন, ঠিকানা লখনৌয়ের আমীর নগর।
তিনি বলেন, তাকে উত্তর প্রদেশ থেকে বিমানে করে আনা হয় এবং 'জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়'। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে তিনি স্বেচ্ছায় সীমান্ত পার হননি।
মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৫ জুলাই রাত সাড়ে ১১টায় স্থানীয়রা যখন তাকে ঘিরে ধরে, তখন শিবু ব্যাখ্যা করতে পারেননি যে তিনি কীভাবে বাংলাদেশে এসেছেন।
আদালত শাহজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) এ বিষয়ে বিস্তারিত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। ২৪ নভেম্বরের মধ্যে পুলিশি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। আদেশ কার্যকর করার জন্য একটি অনুলিপি থানায় পাঠানো হয়েছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আজফাল হোসেন বলেন, শিবু কীভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন এবং কমলাপুরে পৌঁছেছেন, সেটি তারা এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি।
বৃহত্তর চিত্র
মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো দীর্ঘদিন ধরে 'পুশ-ইন'—অর্থাৎ ভারতীয় কর্তৃপক্ষের জোরপূর্বক লোকজনকে সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে পাঠানোর এই চর্চা—নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে।
চলতি বছরের ৭ মে থেকে এ পর্যন্ত ২০০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ ২ হাজারের বেশি মানুষকে এভাবে পুশ-ইন করা হয়েছে। শিবু—যিনি বলছেন তার বাংলাদেশে আসার কোনো ইচ্ছাই ছিল না—এখন তাদেরই একজন।
তার আইনজীবী আশা করছেন, শেষপর্যন্ত তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। তবে আপাতত তিনি পরবর্তী শুনানির অপেক্ষায় ঢাকায় কারাবন্দি আছেন।
টিবিএস ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের অন্তত দুজন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করেছিল, কিন্তু তারা শিবুর পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের করা কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি।



.png)
.png)