একের পর এক গণমাধ্যমে ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছেন পালিয়ে ভারতে অবস্থান করা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণমাধ্যমে তার কথা বলা থামাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। গত বুধবার ভারতের দূতকে ডেকে কথা বলার এ সুযোগ বন্ধ করতে অনুরোধ জানায় বাংলাদেশ।
কিন্তু এ পদক্ষেপে সত্যিই কি শেখ হাসিনার বক্তব্য বন্ধ হবে—এনিয়ে কূটনৈতিক মহলে উঠেছে নানান প্রশ্ন। কারণ ভারত বলছে, শেষ হাসিনাকে তারা আশ্রয় দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তিনি কার সঙ্গে কথা বলবেন বা বলবেন না সেটার নিয়ন্ত্রণ সরকার করতে পারে না। কিংবা ভারতের সরকার গণমাধ্যমও নিয়ন্ত্রণ করে না।
গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্স, এএফপি, বিবিসি ও নিউজ১৮ সহ ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন শেখ হাসিনা। বিষয়টি মোটেই ইতিবাচকভাবে নেয়নি বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনাকে মূলধারার ভারতীয় গণমাধ্যমে কথা বলার সুযোগ দেওয়া বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের জন্য মোটেই সহায়ক নয়- এমন যুক্তি তুলে ধরে এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছে ঢাকা।
শেখ হাসিনাকে ভারত কি ‘আনলক’ করতে দিচ্ছে?
গত বুধবার (১২ নভেম্বর) ভারতীয় উপ-হাইকমিশনার পবন ভাদেকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ অবস্থান জানায়। মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগের মহাপরিচালক বৈঠকে ভারতীয় পক্ষকে অবহিত করেন, বিচারাধীন এক পলাতক আসামিকে প্ল্যাটফর্ম দেওয়ার ঘটনাটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশ তার অনুরোধ তুলে ধরলেও ভারত জানিয়ে দিয়েছে—দেশটির গণমাধ্যম স্বাধীন। ফলে কে কার সাক্ষাৎকার নেবে বা প্রচার করবে, তাতে সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। সাক্ষাৎকার বন্ধ করতে ভারতের পক্ষে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়।
বৈঠকের বিষয়ে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের একটি সূত্র জানায়, সেদিনের আলোচনা খুব আন্তরিক পরিবেশেই হয়েছে।
‘বাংলাদেশ তাদের উদ্বেগ জানিয়েছে, আমরা আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছি’ বলেন তিনি। তার প্রশ্ন, ‘ভারতের আগে–পরে আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নিয়েছে। সেসব দেশের দূতদের তো ডাকা হয়নি। তাহলে ভারতকে কেন আলাদা করে বলা হলো?
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভারতে রয়েছেন। এ কারণেই ভারতের কাছে শেখ হাসিনার কথা বলা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়—মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারাধীন একজন পলাতক আসামিকে আশ্রয় দেওয়া এবং তাকে বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর। নয়াদিল্লিকে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম শফিউল্লাহ মনে করেন, ভারত সরকারের সক্রিয় সহায়তা ছাড়া শেখ হাসিনার এই ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার সম্ভব নয়। তার ভাষ্য, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচার প্রক্রিয়ার মুখোমুখি থাকা শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের মন্তব্য, ‘দুর্বল প্রশাসনই তার পতনের কারণ’ মূলত দিল্লির পক্ষ থেকে আগের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সরে আসার ইঙ্গিত।
তিনি বলেন, ‘গত ১৫ বছর ভারত শেখ হাসিনার সরকারকে সব সময় সমর্থন দিয়েছে। বিতর্কিত নির্বাচন হোক বা রাজনৈতিক সংকট, ভারত তাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। সম্পর্ককে ‘সোনালি অধ্যায়’ও বলা হয়েছে। এখন আবার বলা হচ্ছে—দুর্বল শাসনই তার পতনের কারণ। এটা পরিষ্কারভাবে হাসিনার প্রতি ভারতের আস্থাহীনতার প্রকাশ।’
শফিউল্লাহর দাবি, দোভালের মন্তব্যের পর হাসিনার ‘ক্ষুণ্ণ মর্যাদা’ পুনরুদ্ধারের জন্যই ভারত তাকে দিয়ে বারবার গণমাধ্যমে বক্তব্য প্রকাশের ব্যবস্থা করছে।
‘শেখ হাসিনা যে নিরাপত্তাবেষ্টিত পরিবেশে আছেন, সেখানে কোনো গণমাধ্যম সরকারের অনুমতি ছাড়া যেতে পারে না’ মন্তব্য তার।
এম শফিউল্লাহ আরও বলেন, ‘শেখ হাসিনা নজরবন্দি অবস্থায় থাকায় সরাসরি সাক্ষাৎকার দেওয়া সম্ভব নয়। তবুও ভারতের তিন শীর্ষ গণমাধ্যমে প্রকাশিত তার লিখিত সাক্ষাৎকার, এই পুরো আয়োজন ভারতীয় উদ্যোগেই করা।’
তার মতে, জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ভারত বাড়তি তৎপর হয়ে উঠেছে এবং শেখ হাসিনার এ ধারাবাহিক প্রচার দুই দেশের সম্পর্কেও নতুন উত্তেজনা তৈরি করতে পারে।
সাবেক এই কূটনীতিক আরও বলেন, ‘শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেসবের বিচার বাংলাদেশেই হওয়া উচিত। তাই ভারতের উচিত এদেশের মানুষের প্রত্যাশা বিবেচনায় নিয়ে আইনের শাসনের স্বার্থে শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত পাঠানো।’
তার মতে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এবং দুই দেশের সম্পর্কে স্বচ্ছতা ও আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে ভারতকে এ বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে।



.png)
.png)