শেখ হাসিনা
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের রক্তক্ষয়ী ছাত্র আন্দোলন দমন অভিযানের জন্য ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করেছেন—যে দমনপীড়ন শেষ পর্যন্ত তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই মন্তব্য করেছেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এটি তাঁর প্রথম বিস্তারিত সাক্ষাৎকার।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, তিনি ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে প্রায় ১,৪০০ জন নিহত হন।
১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে দৃঢ় হাতে দেশ শাসন করা হাসিনা বর্তমানে ভারতে নির্বাসিত অবস্থায় আছেন। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, গত বছরের আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের কাছে তিনি ক্ষমা চাইবেন কি না, তখন হাসিনা বলেন, “আমরা জাতি হিসেবে যে প্রতিটি সন্তান, ভাইবোন, আত্মীয় ও বন্ধুকে হারিয়েছি, আমি তাদের প্রত্যেকের জন্য শোক প্রকাশ করি” এবং তিনি আরও বলেন, “আমি আমার সমবেদনা জানিয়ে যেতে থাকব।”
তবে তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন যে, তিনি বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেননি। তাঁর বক্তব্য, নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অন্যায্যভাবে আওয়ামী লীগ দলকে বাংলাদেশে নতুন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে।
দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট-কে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) যদি তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, তবে তিনি “অবাক হবেন না, ভীতও নন।” তিনি এ বিচার প্রক্রিয়াকে “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা দ্বারা পরিচালিত এক প্রহসনের বিচার” বলে অভিহিত করেন।
তিনি বলেন, “আইসিটি হলো একটি প্রহসনের আদালত, যা পরিচালিত হচ্ছে আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়ে গঠিত অনির্বাচিত সরকারের অধীনে,” । “এই প্রতিদ্বন্দ্বীদের অনেকেই আমাকে সরাতে যা করা দরকার, তা করতেও পিছপা হবে না। আমার পরিবারের ইতিহাসের কারণে, আমাদের দেশে রাজনৈতিক হত্যার ইতিহাস সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশি সচেতন আর কেউ হতে পারে না। আইসিটির এই পদক্ষেপ সেই নোংরা ঐতিহ্যেরই অংশ।”
হাসিনা গত বছরের বিক্ষোভ চলাকালে নিজের কর্মকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, তিনি ওই ঘটনায় কোনো ব্যক্তিগত দায় স্বীকার করেন না। তিনি সেই আন্দোলনকে “সহিংস বিদ্রোহ” হিসেবে আখ্যা দেন।
এতো বেশি সংখ্যক হতাহতের জন্য দায়ী করেন “মাঠ পর্যায়ে নিরাপত্তা বাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়াকে”। তিনি আরও বলেন, “একজন নেতা হিসেবে শেষ পর্যন্ত নেতৃত্বের দায়ভার আমাকেই নিতে হয়, কিন্তু আমি নিরাপত্তা বাহিনীকে জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছি বা তা চেয়েছি—এই দাবি সম্পূর্ণ ভুল।”
হাসিনা আরও দাবি করেছেন যে, তাঁর সরকার প্রথম দফার হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর একটি স্বাধীন তদন্ত শুরু করেছিল, তবে পরে সেই তদন্তটি তাঁর পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বন্ধ করে দেয়।
গত বছর বাংলাদেশের বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন-পীড়ন বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। তখন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের উপ-আঞ্চলিক পরিচালক বাবু রাম পান্ত বলেছিলেন, “এতো মৃত্যুর সংখ্যা প্রমাণ করে যে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ ভিন্নমত ও প্রতিবাদের প্রতি যে চরম অসহিষ্ণুতা দেখিয়েছে, তা এক গুরুতর নিন্দার বিষয়।”
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফোলকার টার্ক সে সময় বলেছিলেন, “ছাত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলাগুলো বিশেষভাবে হতবাক করার মতো এবং সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।”
ছাত্রনেতৃত্বাধীন আন্দোলনের সময় প্রচলিত নিহতের সংখ্যা নিয়ে হাসিনা আপত্তি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “১,৪০০ জন নিহতের সংখ্যা আইসিটির প্রচারণার উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হচ্ছে, এই সংখ্যা অতিরঞ্জিত।”
গত জুলাই মাসে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। পরে তা রূপ নেয় এক সরকারবিরোধী আন্দোলনে, যেখানে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার শত-সহস্র মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।
নিরাপত্তা বাহিনী নির্মম ও প্রাণঘাতী শক্তি দিয়ে এর জবাব দেয়। প্রথম দফার মৃত্যুর পর আন্দোলনের নেতারা ঘোষণা দেন, শেখ হাসিনার তাৎক্ষণিক পদত্যাগ ছাড়া তারা আর কোনো সমাধান গ্রহণ করবেন না।
হাসিনা বলেন, সরকার সেই সময় যে পদক্ষেপ নিয়েছিল তা ছিল “সৎ উদ্দেশ্যে... প্রাণহানি কমিয়ে আনার জন্য,” কারণ আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল।
হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির তিন দিন পর নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুস দেশে ফিরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি হাসিনাকে জবাবদিহির মুখে আনার অঙ্গীকার করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম হাসিনাকে বর্ণনা করেছেন “মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল পরিকল্পনাকারী ও প্রধান স্থপতি” হিসেবে, যা অভিযোগ করা হয়েছে ছাত্রনেতৃত্বাধীন আন্দোলনের সময় সংঘটিত অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে।
তবে হাসিনার দাবি, সেই সহিংসতা মূলত মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত থেকে উদ্ভূত হয়েছিল, সরকারের কোনো নির্দেশ থেকে নয়। তিনি বলেন, “এই অভিযোগগুলো এমন সাক্ষ্য ও প্রমাণের ওপর নির্ভর করছে যা বিকৃত, প্রভাবিত এবং প্রাসঙ্গিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে—একটি অনির্বাচিত সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য।”
“মূল মাঠপর্যায়ের সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিলেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা, যাদের কাছ থেকে কার্যকরী নির্দেশনা প্রত্যাশা করা হয়েছিল। সেই নির্দেশনাগুলো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে কিছু সিদ্ধান্ত ভুলভাবে নেওয়া হয়ে থাকতে পারে।”
গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই গেয়ে হাসিনা বলেন, তিনি তা করেছিলেন “প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে।” তাঁর ভাষায়, “দেশে থেকে গেলে শুধু আমার জীবনই নয়, আমার আশপাশের মানুষের জীবনও বিপদের মুখে পড়ত।”
দেশ ত্যাগ এবং বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তিনি জোর দিয়ে বলেন যে তিনি এখনো “বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায়” অঙ্গীকারবদ্ধ। “শুধুমাত্র অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনই দেশকে আরোগ্য দিতে পারে।”
ইউনুস ঘোষণা করেছেন যে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যদিও আওয়ামী লীগকে সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হবে না।
মূল খবরটি পড়তে ক্লিক করুন দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট



.png)
.png)