ঢাকা,  শনিবার
১৫ নভেম্বর ২০২৫

Advertisement
Advertisement

যক্ষ্মায় প্রতিদিন মৃত্যু ১২১ জন

প্রকাশিত: ১৪:৩৬, ১১ নভেম্বর ২০২৫

আপডেট: ১৭:৪৫, ১২ নভেম্বর ২০২৫

যক্ষ্মায় প্রতিদিন মৃত্যু ১২১ জন

যক্ষ্মা

তিন দশক ধরে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ ও কারিগরি সহায়তা পাওয়ার পরও দেশে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে বড় সাফল্য নেই। ওষুধ ও কিট কিনতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দাতাদের কাছে জরুরিভাবে অর্থ চেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের নজরদারির অভাব, এনজিওগুলোর ওপর অতিনির্ভরশীলতা ও লক্ষ্যমাত্রা পূরণের চাপ যক্ষ্মা কর্মসূচিকে দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ওপর সরকারের বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কম। জাতীয় কর্মসূচি হলেও যক্ষ্মার কাজের সম্মুখভাগে মূলত এনজিওগুলোকে দেখা যায়। কয়েকটি জেলায় রোগী বৃদ্ধির কারণ জানা যাচ্ছে না। অন্যদিকে উপজেলা পর্যায়ে নষ্ট ওষুধ পাওয়া গেলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এর কোনো তদন্ত করেনি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি কারও নজরদারিতে নেই।

স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচির (সেক্টর কর্মসূচি নামে পরিচিত) অধীন অপারেশন প্ল্যানের (ওপি) আওতায় প্রায় তিন দশক ধরে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি পরিচালিত হয়েছে। দেখা গেছে, অল্প সময়ের জন্য ওপির লাইন ডিরেক্টর নিয়োগ দেওয়া হয়। কাজ বুঝে ওঠার আগেই তাঁকে চলে যেতে হয়, নতুন ডিরেক্টর বসানো হয়। এ বছর জুলাই মাসে সেক্টর কর্মসূচি বিলুপ্ত করেছে সরকার। যক্ষ্মা এখন মাইকোব্যাকটেরিয়াল ডিজিজ কন্ট্রোল (এমবিডিসি) কর্মসূচির আওতায়। এমবিডিসির নতুন পরিচালক আলী হাবিব দায়িত্ব নিয়েছেন দেড় মাস আগে। তিনি অবসরকালীন ছুটিতে যাবেন তিন মাস পর। সরকার তখন আবার নতুন পরিচালক নিয়োগ দেবে।

আলী হাবিব অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে তাঁর কার্যালয়ে এই প্রতিবেদককে বলেন, তিনি নতুন মানুষ। যক্ষ্মা পরিস্থিতি বা কর্মসূচি সম্পর্কে তাঁর ধারণা কম। তিনি কিছুদিন পর যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। ১ নভেম্বর মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ২ নভেম্বর যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। এরপর আর কথা হয়নি।

সরকারের সর্বশেষ হিসাব বলছে, প্রতিবছর প্রায় ৩ লাখ ৭৯ হাজার মানুষ নতুন করে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। প্রতিবছর মারা যান ৪৪ হাজার। অর্থাৎ প্রতিদিন ১ হাজার ৩৮ জন নতুন রোগী যোগ হচ্ছেন এবং মারা যান ১২১ জন। প্রতিদিন দেশজুড়ে মাতৃমৃত্যু, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, আত্মহত্যার চেয়ে অনেক বেশি মৃত্যু যক্ষ্মায়।

সরকারের কাগজপত্র বলছে, বর্তমানে যে ১০টি দেশে যক্ষ্মারোগীর সংখ্যা বেশি, বাংলাদেশ তার অন্যতম। ১৯৯৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যক্ষ্মাকে বৈশ্বিক জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করার পর স্বাস্থ্য বিভাগ এনজিওগুলোকে সঙ্গে নিয়ে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। যক্ষ্মা নির্ণয়, চিকিৎসা ও ওষুধসবই বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। তারপরও দেশে যক্ষ্মা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

সরকারের সর্বশেষ হিসাব বলছে, প্রতিবছর প্রায় ৩ লাখ ৭৯ হাজার মানুষ নতুন করে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। প্রতিবছর মারা যান ৪৪ হাজার। অর্থাৎ প্রতিদিন ১ হাজার ৩৮ জন নতুন রোগী যোগ হচ্ছেন এবং মারা যান ১২১ জন। প্রতিদিন দেশজুড়ে মাতৃমৃত্যু, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, আত্মহত্যার চেয়ে অনেক বেশি মৃত্যু যক্ষ্মায়।

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মার রোগী বাড়ছে। ওষুধের মান ঠিক না থাকলে, নিয়মিত ওষুধ না সেবন করলে, চিকিৎসার পূর্ণ মেয়াদে ওষুধ সেবন না করলে যক্ষ্মার জীবাণু

ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে ওঠে। তখন সাধারণ ওষুধে যক্ষ্মা ভালো হয় না। এটাই ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মা (মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট বা এমডিআর টিবি)। ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মারোগী সরাসরি যক্ষ্মার জীবাণু ছড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমিত হিসাবে প্রতিবছর ৫ হাজার মানুষ নতুন করে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এর অর্ধেক শনাক্ত হচ্ছে না। এর অর্থ হচ্ছে, ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মা নিয়ে অনেকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, জীবাণু ছড়াচ্ছেন।

২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের যক্ষ্মাবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর প্রধানেরা ২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মামুক্ত বিশ্ব গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। একাধিক সরকারি কর্মকর্তা, এনজিও কর্মী ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মী বলেছেন, যক্ষ্মার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে নেই বাংলাদেশ।

ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মারোগী সরাসরি যক্ষ্মার জীবাণু ছড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমিত হিসাবে প্রতিবছর ৫ হাজার মানুষ নতুন করে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এর অর্ধেক শনাক্ত হচ্ছে না। এর অর্থ হচ্ছে, ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মা নিয়ে অনেকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, জীবাণু ছড়াচ্ছেন।

কিট ও ওষুধ তলানিতে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেকোনো স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে ওষুধ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার অন্তত ছয় মাসের ওষুধ মজুত রাখে। যক্ষ্মার ওষুধের ক্ষেত্রেও এতকাল তাই হয়ে এসেছে। কিন্তু সময়মতো সঠিক উদ্যোগ না নেওয়ায় ওষুধের স্বল্পতা দেখা দেওয়ায় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অন্তত দুতিনটি চিঠি থেকে এই সংকটের কথা জানা গেছে।

যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সাবেক লাইন ডিরেক্টর জুবায়দা নাসরিন গত ২৫ জুলাই দাতা সংস্থা স্টপ টিবি পার্টনারশিপের নির্বাহী পরিচালক লুসিকা দিতুইকে লেখা চিঠিতে বলেন, যক্ষ্মার ওষুধ (ফাস্ট লাইন ড্রাগ) ২০২৬ সালের মে মাসে ফুরিয়ে যাবে। জরুরি ভিত্তিতে ওষুধ কেনার জন্য ৬৫ লাখ মার্কিন ডলার সহায়তা দরকার। তিনি আরও লেখেন, যক্ষ্মা শনাক্তে কিট ফুরিয়ে যাবে এ বছরের ডিসেম্বরেই। এ জন্য জরুরি ভিত্তিতে ১ কোটি ৩ লাখ ডলার দরকার। আরও কিছু প্রয়োজন মেটাতে তিনি অর্থসহায়তা চেয়েছেন।

এরপর ১২ আগস্ট সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরস ডিপোর পরিচালক মো. হুজুর আলী স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে চিঠি লিখে ২৩৭ কোটি ১২ লাখ টাকার কিট কেনার জন্য প্রশাসনিক অনুমোদনের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি দাতা সংস্থার প্রতিনিধি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এ বছরও অর্থ ফেরত গেছে। দাতাদের টাকা তারা খরচ করতে পারেনি। এখন আবার টাকার জন্য চিঠি লিখছে। হয় পরিকল্পনায় গোলমাল আছে, না হয় কর্মসূচির বিষয়ে আন্তরিকতার ঘাটতি আছে। তা না হলে যক্ষ্মার ওষুধ বা কিটের ব্যাপারে এমন জরুরি পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে কেন?

অভিযোগ আছে, লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করার চাপে অনেক সময় রোগীর সংখ্যায় কারচুপি করা হয়। যাঁর যক্ষ্মা নেই তাঁকে যক্ষ্মার রোগী হিসেবে দেখানো হয়। অথবা এমন ব্যক্তিকে রোগী হিসেবে দেখানো হয়, যে ব্যক্তির কোনো অস্তিত্ব নেই। অভিযোগটি পুরোনো। এখনো সন্দেহ আছে।

লক্ষ্যমাত্রার চাপে দুর্নীতি

যক্ষ্মারোগী শনাক্ত, ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মারোগী শনাক্ত, শনাক্ত রোগীদের চিকিৎসার আওতায় আনাএ ধরনের প্রতিটি ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। যেমন বছরে নতুন রোগী হয় ৩ লাখ ৭৯ হাজার। লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে, সারা দেশ থেকে মোট নতুন রোগীর ৯০ শতাংশ বা ৩ লাখ ৪১ হাজার ১০০ জনকে শনাক্ত করতে হবে। এই শনাক্তের কাজটি করেন মাঠপর্যায়ের এনজিও কর্মীরা। কর্মীদের এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। প্রতি চার মাস অন্তর এর একটি হিসাব পাওয়া যায়।

অভিযোগ আছে, লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করার চাপে অনেক সময় রোগীর সংখ্যায় কারচুপি করা হয়। যাঁর যক্ষ্মা নেই তাঁকে যক্ষ্মার রোগী হিসেবে দেখানো হয়। অথবা এমন ব্যক্তিকে রোগী হিসেবে দেখানো হয়, যে ব্যক্তির কোনো অস্তিত্ব নেই। অভিযোগটি পুরোনো। এখনো সন্দেহ আছে।

ফরিদপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার আল আমিন সারোয়ার জানান, ২০২৩ সালে ফরিদপুর জেলায় ১ হাজার ৮১৩ জন রোগী শনাক্ত হয়। ২০২৪ সালে শনাক্ত হয় ২৭৫৯ জন। এবং ২০২৫ সালের ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত শনাক্ত হয় ৩ হাজার ৮২ জন। এতে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে রোগী বেড়েছে ৭০ শতাংশ। এই বৃদ্ধি অস্বাভাবিক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন যক্ষ্মা বিশ্লেষক বলেন, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি জেলায় ২০২৩ সালের পর থেকে অস্বাভাবিক রোগী বাড়ছে। রোগতাত্ত্বিক দিক থেকে এর কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।

গবেষকেরা বলেছেন, লক্ষ্য পূরণের চাপ কর্মসূচিকে দুর্নীতিগ্রস্ত করতে পারে। দেশে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মারোগীর অনুমিত সংখ্যা ৫ হাজার। কিন্তু শনাক্ত হয় ২ হাজারের কম। দাতাদের চাপ থাকে এ সংখ্যা বাড়ানোর। গবেষক দলের একজন ছিলেন ব্র্যাকের।

গবেষকেরা দেখেছেন, একজন ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মারোগীর নমুনা আরও একাধিক মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, বাড়তি কয়েকজন রোগহীন ব্যক্তিকে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মারোগী হিসেবে দেখানো হয়েছিল। এর একটি কারণ, দেশে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মারোগীর শনাক্তের সংখ্যা বাড়ানো।

গবেষণাটি ২০১৫ সালে যক্ষ্মাবিষয়ক সাময়িকী ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব টিউবারকিউলেসিস অ্যান্ড লাং ডিজিজেসে প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, দাতাদের পক্ষ থেকে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের চাপ থাকে। ফলে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো একধরনের চাপের মধ্যে থেকে রোগ শনাক্তের যে সংখ্যা দেয়, তা অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত নয়। গবেষকেরা বলেছেন, লক্ষ্য পূরণের চাপ কর্মসূচিকে দুর্নীতিগ্রস্ত করতে পারে। দেশে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মারোগীর অনুমিত সংখ্যা ৫ হাজার। কিন্তু শনাক্ত হয় ২ হাজারের কম। দাতাদের চাপ থাকে এ সংখ্যা বাড়ানোর। গবেষক দলের একজন ছিলেন ব্র্যাকের।

রোগী বেশি দেখানোর প্রবণতা এখনো আছে। এ বছর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মার ৮৪ জন রোগীর নমুনা আবার পরীক্ষা করে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সংক্রামক রোগ শাখা। ওই রোগীদের ওষুধপ্রতিরোধী জীবাণু শনাক্ত হয়েছিল জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ও সহযোগী সংস্থাদের মাঠপর্যায়ের ল্যাবরেটরিতে। আইসিডিডিআরবি তা পুনঃপরীক্ষা করেছিল টার্গেটেড নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিংয়ের (টিএনজিএস) মাধ্যমে। এটাই এই রোগ শনাক্তের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। দেশে এ প্রযুক্তি আছে শুধু আইসিডিডিআরবিতে। যক্ষ্মা শনাক্তের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই প্রযুক্তি সহায়তা দিয়েছে।

সঠিক রোগ নির্ণয় ও ভুল মানুষকে ওষুধ না খাওয়াতে পুনঃপরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থাকে। পরে এ বছর এপ্রিল মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিদ্ধান্ত নেয় যে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মা শনাক্ত হলে পুনরায় বা দ্বিতীয়বার তা আর পরীক্ষা করার দরকার নেই। অনেকে ধারণা করেন, দ্বিতীয়বার পরীক্ষা না করানোর ক্ষেত্রে দাতাদের ভূমিকা ছিল।

পুনঃপরীক্ষায় দেখা গেছে, ৮৪ জনের মধ্যে ১১ জনের দেহে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মার জীবাণু ছিল না। অর্থাৎ ১৩ দশমিক ১ শতাংশ মানুষের রোগ শনাক্ত ঠিক ছিল না।

আইসিডিডিআরবির সংক্রামক রোগ বিভাগের প্রধান সায়েরা বানু বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশকে আধুনিক প্রযুক্তি দিয়েছে। এই প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার হওয়া দরকার। এতে রোগ নির্ণয় ঠিক হবে। ভুল চিকিৎসার ঝুঁকি কম হবে। তিনি আরও বলেন, দেশে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মা শনাক্ত হওয়া সব মানুষের নমুনা আইসিডিডিআরবিতে বিনা খরচে পুনঃপরীক্ষা সম্ভব।

সঠিক রোগ নির্ণয় ও ভুল মানুষকে ওষুধ না খাওয়াতে পুনঃপরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থাকে। পরে এ বছর এপ্রিল মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিদ্ধান্ত নেয় যে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মা শনাক্ত হলে পুনরায় বা দ্বিতীয়বার তা আর পরীক্ষা করার দরকার নেই। অনেকে ধারণা করেন, দ্বিতীয়বার পরীক্ষা না করানোর ক্ষেত্রে দাতাদের ভূমিকা ছিল।

ওষুধ নষ্ট, তদন্ত হয়নি

অপরিষ্কার, স্যাঁতসেঁতে একটি গুদামে যক্ষ্মার যাবতীয় ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী রাখা হয়। সামান্য বৃষ্টিতে গুদামের মধ্যে পানি জমে। বর্ষাকালে এত পানি জমে যে পানি সরাতে সেচযন্ত্র ব্যবহার করতে হয়।

৩০ অক্টোবর দুপুরে রাজধানীর শ্যামলীতে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির গুদামে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে আছে। কোনো কোনো জায়গায় যেতে পানিতে পা বা জুতা ডুবে যায়। একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে দাতা সংস্থা গ্লোবাল ফান্ডের প্রতিনিধিদের এই গুদাম পরিদর্শক করার কথা। সে কারণে গুদাম পরিষ্কার করা হয়েছে, পানিও সরানো হয়েছে।

গুদামের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা গুদাম ঘুরিয়ে দেখানোর সময় প্রথম আলোকে বলেন, বর্ষা হলেই পানি জমবে। গুদাম পরিষ্কার করা বা মালপত্র গোছগাছ করার মতো জনবল নেই। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। তিনি নিজ খরচে জমে থাকা পানি সরিয়েছেন বলে জানান।

এই গুদাম থেকে দেশের সব জেলায় যক্ষ্মার ওষুধ, যক্ষ্মা শনাক্তের কিট ও অন্যান্য সামগ্রী পাঠানো হয়। অভিযোগ উঠেছে, কয়েকটি উপজেলা থেকে যক্ষ্মার ওষুধ ফেরত এসেছে গুদামে। বেশ কয়েকটি উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা লক্ষ করেন যে ওষুধের ফয়েল ফেটে যাচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ঘটনা পুরোনো। দু-একটা উপজেলা থেকে ওষুধ ফেরত এসেছিল। এখন সেই অভিযোগ আর নেই।

নষ্ট ওষুধ বিপজ্জনক। যক্ষ্মার ওষুধের মান ঠিক না থাকলে তা যক্ষ্মা নিরাময় করে না বটে, বাড়তি ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নষ্ট ওষুধের ঘটনাটি জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। এ নিয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। কতটি উপজেলার ওষুধ নষ্ট ছিল, তাও জানা যায়নি।

পরামর্শ কেউ শোনে না

জয়েন্ট মনিটরিং মিশনের সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে যক্ষ্মায় আক্রান্তের সংখ্যা ও যক্ষ্মায় মৃত্যুর সংখ্যা কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে নেই বাংলাদেশ। ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ হাজার ও মৃত্যুর সংখ্যা ৬ হাজারে নামিয়ে আনতে হবে।

বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সংগঠন সুস্বাস্থ্যের বাংলাদেশের সভাপতি কাজী সাইফউদ্দীন বেন্‌নূর বলেন, এনটিপি বা জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি শুরু থেকে আমলানির্ভর। চিকিৎসক ও অন্যান্য সেবা দারকারীদের মধ্যে সমন্বয় তৈরিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। সমস্যা সমাধানের জন্য গবেষণা বা বিশেষ কোনো উদ্যোগ কর্মসূচির পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি। এসব কারণে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে যক্ষ্মা নির্ণয়ের হার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পিছিয়ে আছে। বাস্তবে জাতীয় কর্মসূচি চলছে নজরদারি ছাড়াই।

Advertisement
Advertisement

Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531