জোহরান মামদানি
যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকলিনে গত মাসে প্রগতিশীল ইহুদি উপাসনালয় সিনাগগ কোলট চায়েনুতে প্রার্থনা সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন নিউইয়র্কের ডেমোক্রেটিক দলীয় মেয়র প্রার্থী জোহরান মামদানি। ইহুদিদের নববর্ষ রোশ হাসানাহ উপলক্ষে এ প্রার্থনা সভার আয়োজন করা হয়। এ সময় ব্যাপক করতালি ও উৎসাহ-উদ্দীপনায় জোহরানকে স্বাগত জানান ইহুদিরা। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ইহুদি জনবসতিপূর্ণ এই শহরে তাঁর জন্য এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ এক রাজনৈতিক মুহূর্ত।
ওই প্রার্থনা সভা ছাড়াও সম্প্রতি বিভিন্ন সিনাগগে এবং ইহুদিদের মহা পবিত্র দিনগুলোর উৎসবে অংশ নিয়েছেন জোহরান। এটি স্পষ্টভাবে তাঁর রাজনৈতিক কৌশলেরই অংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের বোডোইন কলেজে পড়ার সময় জোহরান সেখানে ‘স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন’ নামের একটি সংগঠনের শাখা চালু করেছিলেন। এর প্রায় এক দশক পর তিনি পরিচিতি পেতে শুরু করেন। দীর্ঘদিনের নির্ভীক ও প্রকাশ্য ফিলিস্তিনিপন্থী অবস্থান তাঁর রাজনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে তা বিরোধীদের কাছে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুও হয়ে দাঁড়ায়।
আগামী ৪ নভেম্বর নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর আগেই জোহরান এমন এক সূক্ষ্ম ভারসাম্যের পথে হাঁটছেন, যেখানে একদিকে রয়েছে তাঁর দীর্ঘদিনের ইসরায়েলবিরোধী ও ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থান, অন্যদিকে তিনি বিশাল ইহুদি জনগোষ্ঠীর সমর্থন আদায়েও কাজ করে যাচ্ছেন।
অন্যদিকে, বর্জন, বিনিয়োগ প্রত্যাহার ও নিষেধাজ্ঞা (বিডিএস) আন্দোলনে প্রকাশ্য সমর্থন এবং ইসরায়েলকে ইহুদি রাষ্ট্র বলতে অস্বীকৃতি জানানোয় উগ্র ডানপন্থী রাজনৈতিক কর্মী, কংগ্রেসের ইহুদি ডেমোক্র্যাট ও জায়নবাদী অধিকারগোষ্ঠীগুলোর সমালোচনার মুখে পড়ছেন এই মেয়র প্রার্থী।
জোহরানকে নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও জরিপে দেখা যাচ্ছে, নিউইয়র্কে বসবাসরত ইহুদি ভোটারদের মধ্যে জোহরান মামদানিই সবচেয়ে এগিয়ে আছেন।
গত জুলাইয়ে জেনিথ রিসার্চ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, জোহরান ইহুদি ভোটারদের মধ্যে ১৭ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন। এমনকি বিভিন্ন ইহুদি উপগোষ্ঠীর মধ্যেও এগিয়ে আছেন তিনি।
গবেষক অ্যাডাম কার্লসন বলেন, ‘ইহুদি সমাজের মধ্যে ধর্ম, বয়স, রাজনীতিসহ নানা বিভাজন রয়েছে। আমাদের জরিপে দেখা গেছে, নিউইয়র্কের ইহুদি ভোটারদের একটি বড় অংশের মধ্যে জোহরানের প্রতি সমর্থন প্রত্যাশার চেয়ে বেশি।’
জোহরানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে একাধিক প্রগতিশীল ইহুদি সংগঠন। যেমন বেন্ড দ্য আর্ক, জিউইশ ভয়েস ফর পিস (জেভিপি) অ্যাকশন এবং জিউস ফর রেসিয়াল অ্যান্ড ইকোনমিক জাস্টিস (জেএফআরইজে)। এসব সংগঠন প্রকাশ্যে গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের ভূমিকার সমালোচনা করেছে এবং জোহরানের প্রচারে মাঠে নেমেছে।
জিউইশ ভয়েস ফর পিস (জেভিপি) অ্যাকশনের রাজনৈতিক পরিচালক এবং সিনাগগ কোলট চায়েনুর সদস্য বেথ মিলার বলেন, রোশ হাসানাহর প্রার্থনা সভায় জোহরান উপস্থিত হওয়ায় মানুষ এত খুশি হয়েছিলেন যে তাঁরা প্রার্থনা শেষে তাঁকে ঘিরে ভিড় করেন। সেলিব্রিটি হওয়ার কারণে নয়, বরং তাঁরা উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে তিনি মেয়র হলে হয়তো সবাই মিলে নতুন কিছু গড়ে তোলা যাবে।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময় থেকেই সংগঠনটির নির্বাচনী শাখা দ্য জিউইশ ভোট তাঁকে সমর্থন দিয়েছিল। সংগঠনটির সদস্যরা নিয়মিত প্রচার ও বিক্ষোভে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন।
সংগঠনটির রাজনৈতিক পরিচালক অ্যালিসিয়া সিংহাম গুডউইন বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে আন্দোলন থেকে গ্রেপ্তার হয়েছি। এটা প্রমাণ করে যে তিনি (জোহরান) তাঁর নৈতিক অবস্থানে অটুট রাখতে বড় ঝুঁকিও নিতে প্রস্তুত।’
কেবল প্রগতিশীল ইহুদি সংগঠনগুলোর সমর্থন নয়, বরং ইহুদি ভোটারদের মনে আস্থা তৈরির ক্ষেত্রে কৌশলগত প্রচেষ্টাও জোহরানকে সাফল্য এনে দিচ্ছে।
নিউইয়র্কের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দ্য নিউ স্কুলের অধ্যাপক ভ্যাল ভিনোকুর বলেন, জোহরান প্রগতিশীল জায়নবাদীদের কাছে টানতে তাঁর ভাষা ও বক্তব্যে ভারসাম্য রাখছেন। এতে তাঁর জায়নবাদবিরোধী সমর্থকদের কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হলেও, রাজনৈতিকভাবে এটি বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ।
একসময় বিতর্কিত স্লোগান ‘গ্লোবালাইজ দ্য ইনতিফাদা’–এর পক্ষে জোহরান মামদানির দৃঢ় অবস্থান ছিল। ফিলিস্তিনপন্থী এই স্লোগানকে সমর্থনের কারণে ইহুদি সম্প্রদায়ের একটি অংশের সঙ্গে জোহরানের উত্তেজনা দেখা দেয়। একপর্যায়ে তিনি বলেন, এই স্লোগানের ব্যবহারকে তিনি নিরুৎসাহিত করবেন। এটি ছিল তাঁর নির্বাচনে কৌশলের একটি অংশ।
গাজা যুদ্ধের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে ডেমোক্র্যাট মেয়র প্রার্থী এক বিবৃতিতে হামাসের হামলাকে ‘নৃশংসতা’ এবং গাজায় ইসরায়েলের অভিযানকে ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যা দেন। এ কারণে ব্যাপক সমালোচনার মুখেও পড়েন তিনি।
এ বিষয়ে গবেষক অ্যাডাম কার্লসন বলেন, জোহরান এমন বক্তব্য দিয়েছেন, যা কাউকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করেনি; কখনো কখনো সেটাই একজন নেতার কাজ।
ইহুদি সমাজের রাজনৈতিক বিভাজন এখন আগের চেয়ে জটিল। তরুণ, উদারপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ ইহুদিরা ক্রমেই ফিলিস্তিনপন্থী হয়ে উঠছেন।
বেথ মিলার বলেন, জায়নবাদের ইতিহাস যত পুরোনো, এটির বিরোধিতার ইতিহাসও তত পুরোনো। আমি ৭০-৯০ বছর বয়সী বহু ইহুদির কাছে শুনেছি, তাঁরা আজীবন জায়নবাদের বিরোধী ছিলেন। কারণ, তাঁরা কখনোই কোনো জাতিরাষ্ট্রকে নিজেদের পরিচয়ের প্রতীক মনে করেননি।
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ইহুদি অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক জনাথন বয়ারিন বলেন, যাঁরা জায়নবাদের বিরোধিতা ও ইহুদিবিদ্বেষকে এক করে ফেলেন, তাঁরা মূলত চরমপন্থার মানুষ। জোহরান মামদানি তাঁদের মতো নন।
অধ্যাপক ভিনোকুরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া সরে না দাঁড়ালে জোহরান প্রায় নিশ্চিতভাবে নির্বাচনে জয়ী হবেন। তিনি বলেন, জোহরান তাঁর জায়নবাদবিরোধী অবস্থান সত্ত্বেও ইহুদিদের ভোট পাবেন। কারণ, তরুণ ইহুদিরা এখন শহরটিকে আরও বাসযোগ্য, সাশ্রয়ী ও ন্যায়সংগত দেখতে চান।



.png)
.png)