
বিয়ে বিচ্ছেদ
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর অনামিকা আক্তার ও পুরান ঢাকার পারভেজ আলম—দুই ভিন্ন মানুষের জীবন, তবে তাদের গল্পের গন্তব্য এক। ভালোবাসার পরিণতি হিসেবে বিয়ে করলেও শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদই হয়েছে তাদের ভাগ্যে। যাত্রাবাড়ীর অনামিকা প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন ব্যবসায়ী শামীম রহমানকে। সন্তান জন্মের পরও সংসার ভালো চলছিল, কিন্তু শামীমের নতুন সম্পর্কে জড়ানোয় সৃষ্টি হয় অশান্তি, যার পরিণতিতে ঘটে বিচ্ছেদ। অন্যদিকে, উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপে পাড়ি জমানো পারভেজ স্ত্রী প্রিয়ার বিশ্বাসঘাতকতার খবর পেয়ে দেশে ফিরে তালাকের আবেদন করেন।
এই ব্যক্তিগত গল্পগুলো যেন হয়ে উঠছে ঢাকার একটি বড় বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) রাজস্ব বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে এই এলাকায় ৭ হাজার ৯১৩টি বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৫ হাজার ৭৬৪টি তালাকের আবেদন করেছেন স্ত্রী, যা স্বামীর আবেদনের তুলনায় আড়াইগুণেরও বেশি।
বছরওয়ারি তালাকের পরিসংখ্যান বলছে:
-
২০২4: মোট বিচ্ছেদ ৭,৯১৩টি (স্বামীর আবেদন ২,১৪৯টি, স্ত্রীর আবেদন ৫,৭৬৪টি)
-
২০২৩: মোট বিচ্ছেদ ৭,৩০৬টি (স্বামীর ২,০২০টি, স্ত্রীর ৫,২৮৬টি)
-
২০২২: মোট বিচ্ছেদ ৭,৬৯৮টি (স্বামীর ২,৩১৫টি, স্ত্রীর ৫,৩৮৩টি)
-
২০২১: মোট বিচ্ছেদ ৭,২৪৫টি (স্বামীর ২,০৬২টি, স্ত্রীর ৫,১৮৩টি)
-
২০২০: মোট বিচ্ছেদ ৬,৩৪৫টি
এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, সময়ের সঙ্গে তালাকের হার যেমন বেড়েছে, তেমনি নারীদের বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে।
বিশ্লেষণে উঠে এসেছে নানা সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক কারণ
ডিএসসিসির গবেষণা কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান জানান, বর্তমানে তালাকের পেছনে প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পরকীয়া সম্পর্ক ও পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি। অতীতে যৌতুক ও নির্যাতন যেখানে বড় কারণ ছিল, এখন পারিবারিক টানাপোড়েন ও সম্পর্কের অবনতি বেশি দেখা যাচ্ছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শিপ্রা সরকার মনে করেন, নারীর আর্থিক স্বনির্ভরতা তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। এখন তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হন, সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেন না। ফলে অন্যায় সহ্য না করে তালাককে বেছে নিচ্ছেন।
সমাজবিজ্ঞানী আমিনুল ইসলাম বলেন, “সংসারে শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা কমে গেছে। অনেকেই নিজেদের সঠিক মনে করেন, কিন্তু সংসার টিকিয়ে রাখতে দরকার সম্মান ও বিশ্বাস।” তিনি আরও যোগ করেন, “ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির গুরুত্ব না দিলে এই প্রবণতা আরও বাড়বে।”
বর্তমান নগরজীবনে সম্পর্কের জটিলতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাড়তি সংযোগ, পারিবারিক সময়ের অভাব, এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার বিস্তার তালাকের হার বাড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সুস্থ সম্পর্ক রক্ষায় চাই পারস্পরিক বোঝাপড়া, সম্মান, ধৈর্য ও সময় দেওয়া—যা ক্রমেই যেন হারিয়ে যাচ্ছে নাগরিক জীবনের ব্যস্ততায়।