
টিউলিপ সিদ্দিক
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির এমপি ও সাবেক সিটি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিককে বলতে শোনা যায়, “আমি বাংলাদেশি নই, আমি একজন ব্রিটিশ এমপি।” ভিডিওটিকে ঘিরে শুরু হয়েছে জোর বিতর্ক। ভিডিওটি দেখে অনেকেই ধারণা করছেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং তার খালা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কিছুটা বিরক্ত হয়ে সাফ জানিয়ে দেন, “সতর্ক হোন। এসব ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।”
যদিও অনুসন্ধান বলছে, ভিডিওটি সাম্প্রতিক নয়; বরং ২০১৭ সালের ২৯ নভেম্বর যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম Channel 4 News-এ প্রচারিত একটি সাক্ষাৎকারের অংশ। সেখানে বাংলাদেশের নিখোঁজ ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাসেম বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে টিউলিপ বলেন, তিনি একজন ব্রিটিশ নাগরিক ও এমপি।
তবে তথ্যপ্রমাণ বলছে ভিন্ন কথা। জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), পাসপোর্ট এবং কর শনাক্তকরণ নম্বর (TIN)–সবই বলছে, টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশের নাগরিক এবং ভোটার।
বাংলাদেশি পরিচয় ও করদাতা হিসেবে প্রমাণ:
-
তার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ইস্যু হয় ২০১১ সালের ৩ জানুয়ারি, যার তথ্য অনুযায়ী তিনি ঢাকার ধানমন্ডির বাসিন্দা এবং জন্ম তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮২।
-
২০০১ সালে লন্ডনে অবস্থানকালে ইস্যু হওয়া তার প্রথম বাংলাদেশি পাসপোর্টে জন্মস্থান ও পাসপোর্ট প্রদানের স্থান ছিল যুক্তরাজ্য। এরপর ২০১১ সালে বাংলাদেশ থেকে দ্বিতীয় দফায় পাসপোর্ট নবায়ন করেন।
-
তিনি ২০০৭-০৮ করবর্ষ থেকে বাংলাদেশে করদাতা হিসেবে নিবন্ধিত, এবং নিয়মিত আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন।
২০২৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের নির্দেশে টিউলিপসহ শেখ হাসিনার পরিবারের ১০ সদস্যের এনআইডি লক করে দেওয়া হয়।
দুর্নীতির অভিযোগ ও মামলার বিস্তার:
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দুর্নীতির তদন্তে নতুন গতি পায়। দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) অভিযোগ করে, টিউলিপ সিদ্দিক অবৈধভাবে গুলশানের একটি প্লট হস্তান্তরের অনুমোদন পাইয়ে দিয়ে ইস্টার্ন হাউজিং থেকে একটি ফ্ল্যাট ঘুষ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এতে আরও বলা হয়, ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে ফ্ল্যাট বরাদ্দের পেছনে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল।
পূর্বাচলে প্লট দুর্নীতির আরেক মামলায়ও টিউলিপকে আসামি করা হয়। সেই মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছেন আদালত।
দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেন, “এটি কম্পাউন্ডেবল কোনো মামলা নয়... আদালতেই নির্ধারিত হবে এর পরিণতি।”
টিউলিপের প্রতিক্রিয়া:
বিতর্কের মাঝেই ব্রিটিশ দৈনিক The Guardian-এ দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় টিউলিপ সিদ্দিক অভিযোগ করেন, “পুরোটা সময় তারা মিডিয়া ট্রায়াল চালিয়েছে... রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচারের শিকার হয়েছি।” তিনি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন যে তিনি কোনো অপরাধ করেছেন।
যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার:
টিউলিপ সিদ্দিক ২০১৫ সাল থেকে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য। সর্বশেষ ২০২4 সালে চতুর্থবারের মতো লেবার পার্টি থেকে নির্বাচিত হন। গত জুলাইয়ে তাকে ‘সিটি মিনিস্টার’ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়, যেখান থেকে তদন্তের চাপের মুখে জানুয়ারিতে তিনি পদত্যাগ করেন।
উপসংহার:
বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যে দ্বৈত পরিচয় এবং রাজনৈতিক দায়-দায়িত্ব নিয়ে জোর বিতর্কের মুখে টিউলিপ সিদ্দিক। একদিকে দুর্নীতির তদন্ত, অন্যদিকে পরিচয় জটিলতা—সব মিলিয়ে এই লেবার পার্টি এমপিকে নিয়ে বিতর্ক থামার কোনো লক্ষণ নেই।