ঢাকা,  শনিবার
২৭ জুলাই ২০২৪

Advertisement
Advertisement

এক রেডিও কিনে দেলোয়ারের গেছে ৬ বিঘা জমি

প্রকাশিত: ১৪:০১, ১৯ মে ২০২৩

এক রেডিও কিনে দেলোয়ারের গেছে ৬ বিঘা জমি

আফতাফ হোসেন

রেডিও কিনলেন ৫ বিঘা জমি বিক্রি করে, আর তা চালাতে ব্যাটারি কিনতে বিক্রি করেন আরও এক বিঘা জমি। এভাবেই শখ পুরন করেছেন সিরাজগঞ্জের দেলোয়ার হোসেন। ঘটনাটি ১৯৬৫ সালের। অত্যন্ত শৌখিন দেলোয়ার শখ পুরন করতে পৈত্রিক ২৬ বিঘা জমি করেছেন।

বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে ৫০ বছর পর সেই ঐতিহাসিক রেডিও উদ্ধার করেছেন দেলোয়ারের কৃষক ছেলে আলতাফ হোসেন।

রেডিওটি দেখতে অনেকে এখন ভিড় করছেন আলতাফ হোসেনের বাড়িতে। কিন্তু রেডিও টি বাজানো যাচ্ছে না। কারণ এটি বাজাতে হলে একসঙ্গে আটটা ব্যাটারি দরকার। যার প্রায় ৪০০ টাকা। আর এ টাকা খরচের সামর্থ্য নেই আলতাফের। কারণ, শখের মূল্য দিতে গিয়ে বাবা তাদের নিঃস্ব করে গেছেন। রেডিওটার গায়ে লেখা আছে নিপ্পন ইলেকট্রনিক কোম্পানি লিমিটেড, জাপান।

বাবার সেই কাহিনি বলতে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি আলতাফ। তিনি বলেন, বাবা দেলোয়ার হোসেনের বাড়ি ছিল সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার রহিমাবাদ গ্রামে। তিনি বড় ছেলে। বয়স এখন ৬৬। কাজ করেন মানুষের বাড়িতে। অথচ তাদের পৈত্রিক অনেক সম্পত্তি ছিল। বাবা দেলোয়ার শখ পুরন করতে গিয়ে সব শেষ করেছেন। সেসব জমির দাম এখন কোটি টাকার উপর।

রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন,  জমি বিক্রি করে রেডিও কেনার ঘটনা ঠিক। সব জমিজিরাত বিক্রি করে গেছেন তার বাবা। এখন ছেলেদের আর কিছু নেই। তবে আলতাফ খুব সৎ মানুষ। সবাই তাকে ভালোবাসেন। তাঁর স্ত্রী চায়না খাতুন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের সদস্য। সততার সঙ্গে কাজ করেন।

আলতাফ হোসেন বললেন, বাবা খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন। পাঁচ বিঘা জমি বিক্রি করে পাবনা থেকে ২৫০ টাকায় জাপানি তিন ব্যান্ডের আট ব্যাটারির রেডিওটি  কিনে আনলেন। তখন জমিও সস্তা ছিল। মাত্র ৫০ টাকা বিঘা জমি কেনা বেচা হতো। একসঙ্গে রেডিওতে আটটা ব্যাটারি লাগাতে হতো। একসেট ব্যাটারি সারাক্ষণ বাজালে ২৪ ঘণ্টা চলত। বাবা দুলাল কুন্ডুর দোকান থেকে কার্টন ধরে ব্যাটারি কিনে আনলেন। তার এ জন্য আরেক বিঘা জমি বিক্রি করলেন। সেই জমির দাম এখন এক কোটি টাকা।

তিনি বলেন, সেই রেডিওতে গান শুনতে গ্রামের মানুষ বাড়িতে ভীর করতো। তখন নিনা হামিদ, আব্বাসউদ্দীন, আব্দুল আলীমের গান বাজতো। এ অঞ্চলে আর কোনো রেডিও ছিল না। বাবা বাড়িতে আসা মানুষদের তামাক আর পাতার বিড়ি কিনে দিতেন। তারা বসে হুক্কা টানত, বিড়ি খেত আর গান শুনত। এরপর ’৭০এর নির্বাচন, একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, যুদ্ধের খবর মানুষ বসে থেকে শুনছে।

আলতাফ হোসেন বলেন, বাবার শখের শেষ ছিল না। এলাকার মানুষ যা চাইতেন, বাবা তাই দিতেন। সবাইকে খুশি করতে গিয়ে একসময় পৈতৃক ২৬ বিঘা জমি শেষ হয়ে গেল। ১৯৭২ সালে রেডিওটাও ১৮০ টাকায় বিক্রি করে দিলেন। তখন আমি চিক্কর দিয়া উঠলাম। কইলাম বাবা, জমিও গেল, রেডিও গেল! বাবা আমাক সান্ত্বনা দিয়ে কইলেন, আবার কিনে দিব।

আলতাফ বলেন স্থানীয় জিল্লার খন্দকার নামের এক ব্যক্তি রেডিওটি কিনেছিলেন। রেডিওটি ফেরত নিতে তিনি দিনে দুবার করে তার বাড়িতে যেতেন। কিন্তু তিনি  কিছুতেই দিতে চান না। ২০১০ সালে জিল্লার খন্দকার মারা গেলে রেডিওটা তার ছেলে আমজাদের কাছে ছিল। তার কাছেও অনেকবার চাইলে তিনি দেননি, বলতেন বাবা মারা যাওয়ার আগে কোথায় রেখে গেছে জানেন না। তবু হাল ছাড়েন না আলতাফ।

২০২২ সালে ২৬ জানুয়ারি সকাল সাতটায় ৫০০ টাকার একটা নোট নিয়ে তিনি আমজাদের কাছে গিয়ে অনুনয় করে আলতাফ বলেন, রেডিওটা ফেরত না দিলে আপনার বাবা কবরে কষ্ট পাবেন। এ কথা শুনে টাকা ছাড়াই আমজাদ তার হাতে রেডিওটি তুলে দেন। আলতাফ বলেন, পাঁচ বছর বয়স থেকে তিনি রাখালি করছেন। সারা জীবন শুধুই কষ্ট করে গেছে। এ জন্য বিয়ে করতেও দেরি হয়েছে। সবে মেয়েটা এইচএসসি পাস করেছে। ছেলেটা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সংসারই চলে না। বাবার রেডিওর সেই আওয়াজ ভুলতে পারেন না। মন চায় রেডিওটা বাজাতে। আটটা ব্যাটারির দাম এখন ৪০০ টাকা। বিদ্যুতে শুনবেন, তার জন্য মিস্ত্রির কাছে নিতে হবে। সে সামর্থ্যও তার নেই। বলতে বলতে আলতাফ হোসেন রেডিওটা বুকের কাছে ধরেন। চোখ ছলছল করতে থাকে।

Advertisement
Advertisement

Notice: Undefined variable: sAddThis in /mnt/volume_sgp1_05/p1kq0rsou/public_html/details.php on line 531