ঢাকা,  শনিবার
২২ নভেম্বর ২০২৫

Advertisement
Advertisement

বিএনপি ঘোষিত প্রার্থির তালিকা পুনর্মূল্যায়ন করছে

প্রকাশিত: ১৬:০৮, ২২ নভেম্বর ২০২৫

আপডেট: ১৯:০৩, ২২ নভেম্বর ২০২৫

বিএনপি ঘোষিত প্রার্থির তালিকা পুনর্মূল্যায়ন করছে

বিএনপি

জাতীয় নির্বাচনে দলের প্রার্থিতা নিয়ে নেতাকর্মীদের অস্থিরতা নিরসনে উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। বিরোধপূর্ণ আসনগুলোতে আবারও জরিপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। জরিপে যে ফলাফল আসবে, তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন শীর্ষ নেতৃত্ব। এই প্রক্রিয়ায় প্রায় অর্ধশত আসনে পরিবর্তন আসতে পারে বলে দলীয় সূত্র দাবি করেছে।

বিএনপি নেতারা জানান, মাঠ পর্যায়ে একাধিক জরিপ, বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে ৩ নভেম্বর ২৩৭ আসনে প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে বিএনপি। এরপর থেকে অনেক আসনে বিক্ষোভ শুরু করেন অন্য নেতাদের কর্মী-সমর্থকরা। কোথাও কোথাও সংঘাত-সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশনা দিলেও মাঠ পর্যায়ে এর প্রতিফলন ঘটেনি। অনেক আসনে পদবঞ্চিত নেতারা স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন।

এখন জরিপ প্রক্রিয়ায় বিএনপি নিজেদের বঞ্চিত ভাবা নেতাদের ক্ষোভ প্রশমনে উদ্যোগ নিয়েছে। কোনো কোনো আসনের মনোনয়নবঞ্চিতদের ঢাকায় ডেকে এনে কথাও বলা হয়েছে। অনেকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়েছে। ওই সব নেতা তাদের আসনে নিরপেক্ষভাবে জনপ্রিয়তা যাচাই করে প্রার্থিতা পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেছেন।

বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, আসনভিত্তিক কোন্দলের সঠিক কারণ, প্রার্থীদের দুর্বলতা, মনোনয়নবঞ্চিত নেতার অবস্থান পুনর্মূল্যায়নে কাজ করছে দলের একটি টিম। দলীয় প্রধানের একজন উপদেষ্টা এবং একজন শিক্ষক প্রতিনিধিকে দিয়ে মাঠ জরিপ করানো হচ্ছে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রার্থী তালিকা পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, দল আগেই বলেছে, এটা চূড়ান্ত তালিকা নয়, সম্ভাব্য তালিকা। কোনো এলাকায় পরিবর্তন দরকার মনে করলে, অবশ্যই তা করা হবে। সবকিছু বিশ্লেষণ করেই তালিকা করা হয়।

তবে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, আগেও মাঠ জরিপের নামে অনেক আসনে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। জেলা ও বিভাগীয় নেতারা তাদের পছন্দমতো নেতাকে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছেন। এমনকি প্রার্থী তালিকা ঘোষণার আগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রত্যেক বিভাগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বৈঠক আয়োজনেও পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগ রয়েছে। বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের অপছন্দ হলে তাঁকে ওই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। জরিপ কাজেও তারা প্রভাব বিস্তার করেছেন। এ কারণে অনেক আসনে ত্যাগী, যোগ্যরা বাদ পড়েছেন।

দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, কয়েক দফা মাঠ জরিপ, সাংগঠনিক নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে এবারের সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। তবে তপশিল ঘোষণার আগে-পরে এই তালিকা প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তন হতে পারে। কোনো অবস্থাতেই তৃণমূলের কোন্দলকে মেনে নেওয়া হবে না। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে নির্বাচনে যেতে হবে। এজন্য যা যা করার দরকার, দল তাই করবে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে সাবেক এমপি মুশফিকুর রহমানকে সম্ভাব্য প্রার্থী করা হয়েছে। তাঁর বয়স ৮৮ বছর। চলাফেরা করতে কষ্ট হয়। স্থানীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, ১৭ বছর মুশফিকুর রহমান কানাডাপ্রবাসী ছিলেন। ৫ আগস্টের পর দেশে আসেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট শাহ আলমের কাছে পরাজয়ের পর তিনি রাজনীতি থেকে সরে যান। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি তাঁকে মনোনীত করলেও মনোনয়নপত্রে ভুল করে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে ছিটকে পড়েন।

এই আসনে অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী কবির আহমদ ভূঁইয়ার পক্ষে দুই উপজেলার নেতাকর্মীরা মাঠে নেমেছেন। প্রতিদিনই কর্মসূচি পালন করছেন।

কুষ্টিয়া-৪ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সাবেক এমপি সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমিকে। আশি বছরের বেশি বয়সী এই নেতা দলে সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত। তিনি গত ১৭ বছর এলাকায় তেমন সক্রিয় ছিলেন না বলে অভিযোগ নেতাকর্মীদের।

এই আসনে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ সাদী মনোনয়ন চাইছেন। শেখ সাদীকে সক্রিয় নেতা দাবি করেছেন তরুণরা। এখানে মনোনয়নে পরিবর্তন না এলে অঘটন ঘটতে পারে বলে মনে করছেন খোকসা উপজেলা বিএনপির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন খান।

জামালপুর-২ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সুলতান মাহমুদ বাবুকে। বয়সের কারণে তিনি প্রায় অসুস্থ থাকেন বলে নেতারা জানান। তিনি সংস্কারপন্থি বলে অভিযোগ আছে। আগে তিনি কে এম ওবায়দুর রহমানের সঙ্গে দল ভেঙে চলে গিয়েছিলেন।

এই আসনে অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এ এস এম আব্দুল হালিম। এই আসনের ইসলামপুর উপজেলার পশ্চিমাঞ্চলে সর্বোচ্চ ভোট রয়েছে। সেখানেই তাঁর বাড়ি।

ঢাকা-৫ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে নবীউল্লাহ নবীকে। তাঁকে নিয়ে একদিকে যেমন বিতর্ক আছে, তেমনি তাঁর বয়স ভাবাচ্ছে দলকে। এই আসনেও প্রার্থী বদল চায় দলের এক অংশ।

নরসিংদী-৪ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুলের নাম ঘোষণা করেছে বিএনপি। সাবেক এই এমপি ওয়ান-ইলেভেনে সংস্কারপন্থি ছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রয়াত শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের আত্মীয় তিনি। ফলে বিগত দিনে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা-হামলা হয়নি।

এখানে ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল প্রার্থী হতে চান। তাঁর অনুসারীরা বলছেন, গত ১৭ বছর মামলা-হামলায় জর্জরিত তিনি।

চট্টগ্রাম-১২ আসনে বিতর্কিত নেতা এনামুল হককে মনোনয়ন দিয়েছে দল। নেতাকর্মীরা জানান, ২০২৪ সালের ২৯ আগস্ট রাতে নগরীর কালুরঘাট শিল্প এলাকার (বিসিক) মীর গ্রুপের ওয়্যারহাউস থেকে ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি সরিয়ে নেওয়া হয়। গাড়িগুলো ছিল এস আলম গ্রুপের। এ ঘটনায় ২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক মো. এনামুল হক এনামকে প্রাথমিক সদস্যসহ সব পদ থেকে স্থগিত করা হয়। ৩০ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধনে বিএনপির তৃণমূল কর্মীরা অভিযোগ করেন, এনামুল হক আওয়ামী লীগ আমলে চাল ব্যবসায়ী হিসেবে আঁতাত করে ব্যবসা ও রাজনীতি করেছেন। এনামকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারণা চলছে। তাদের অভিযোগ, ফ্যাসিবাদী শাসনামলে সাধারণ কর্মীরা যখন নির্যাতিত হয়েছেন, তখন এনাম ছিলেন সুবিধাভোগী। এনামের বিরুদ্ধে কেন্দ্রে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন চার মনোনয়নপ্রত্যাশী।

চট্টগ্রাম-১৩ আসনে সরওয়ার জামাল নিজাম প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন। ৮০ বছরেরও বেশি বয়স্ক এই নেতার অতীত কর্মকাণ্ডসহ নানা বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে লিখিত জানানো হয়েছে। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির শীর্ষ তিন নেতা স্বাক্ষরিত এক আবেদনে বলা হয়, দীর্ঘ সময় সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় এই নেতার মনোনয়নে অনেকেই হতবাক ও ব্যথিত। মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবিতে আন্দোলন করছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আব্বাস বলেন, দলের দুঃসময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন– এ রকম কাউকে প্রার্থী দেওয়ার জন্য হাইকমান্ডের কাছে আবেদন করছেন।

নেত্রকোনা-৫ আসনের (পূর্বধলা উপজেলা) বিএনপি মনোনীত সম্ভাব্য প্রার্থী আবু তাহের তালুকদারের কিছু ভিডিও প্রকাশ হওয়ায় দল বিতর্কে পড়েছে। এই আসনে প্রার্থী পরিবর্তন না হলে অর্ধেক নারী ভোটার বিমুখ হতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন উপজেলা বিএনপির সদস্য ইকরামুল আলম।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে এম এ হান্নানকে। এই আসনে অ্যাডভোকেট একেএম কামরুজ্জামান মামুন মনোনয়ন চান।

সিরাজগঞ্জ-৩ আসনে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন আইনুল হক। তাঁর বিরুদ্ধে এলাকায় নানা অভিযোগ রয়েছে। এ আসনে মনোনয়নের জন্য বিএনপির দুঃসময়ের নেতাদের বিবেচনা করা হয়নি বলে ক্ষোভ জানান স্থানীয় বিএনপির নেতারা। তিন মনোনয়নপ্রত্যাশী আইনুল হকের মনোনয়ন বাতিল চেয়ে তারেক রহমানের কাছে চিঠি দিয়েছেন।

নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনে বিএনপির প্রয়াত নেতা ফজলুর রহমান পটলের ছোট মেয়ে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুলকে মনোনয়ন দিয়েছে দল। কিন্তু তাঁর আপন বড় ভাই ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক ভিপি ডা. ইয়াসির আরশাদ রাজন তাঁর বোনের প্রার্থিতা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছেন।

এই আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বিগত বছরগুলোতে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা, দলের সাংগঠনিক তৎপরতা কিংবা নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে কাজ করেছেন। প্রার্থিতা বদল না হলে তাইফুল ইসলাম টিপু স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন।

এ ছাড়া গাইবান্ধা-৪, নোয়াখালী-৫, সাতক্ষীরা-২ ও ৩; টাঙ্গাইল-১, নীলফামারী-৪; বান্দরবান, শেরপুর-২, হবিগঞ্জ-৪, জয়পুরহাট-১ ও ২; ময়মনসিংহ-৩, ৬, ৯ ও ১১, মুন্সীগঞ্জ-১; কুমিল্লা-৫, ৬ ও ১০; কুড়িগ্রাম-১ ও ৩; রাজশাহী-১, ৩ ও ৪; রাজবাড়ী-২; নওগাঁ-১, ৩ ও ৪; পাবনা-৪ এবং মৌলভীবাজার-২ আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন চলছে।

Advertisement
Advertisement

Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531