ইসরাইলী কুখ্যাত বন্দী শিবির এসডিই তাইমানের। যা ‘ডেথ ক্যাম্প’ হিসেবে পরিচিত ’। তার লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া প্রথম আইনজীবী খালেদ মুহাজিনাহ।
সম্প্রতি তিনি তার মক্কেল আল আরাবিয়া নেটওয়ার্কের গাজা প্রতিনিধি সাংবাদিক মুহাম্মাদ আরাবের সাথে ‘ডেথ ক্যাম্পে’ দেখা করতে যান। যাকে গত ১০০ দিন যাবত কুখ্যাত কারাগারটিতে আটক রেখেছে ইহুদিবাদী ইসরাইল।
‘ডেথ ক্যাম্পের’ প্রকৃত অবস্থা কেমন তা জানতে প্রথমবারের মতো প্রবেশের অনুমতি পাওয়া এই আইনজীবীর সাক্ষাতকার নেয় হিব্রু পত্রিকা মেকোমিত।
তার বর্ণনায় উঠে আসে বেসামরিক ফিলিস্তিনি বন্দীদের নির্যাতনের অত্যন্ত লোমহর্ষক চিত্র। বন্দী শিবিরটিকে তিনি কুখ্যাত আবু গারিব ও গুয়েন্তামো কারাগারের চেয়েও ভয়াবহ ও কুখ্যাত বলে উল্লেখ করেন।
আইনজীবী মুহাজিনাহ বলেন, রাজনৈতিক ও সাধারণ ব্যক্তিত্বদের আইনজীবী হিসেবে আমি বহু বছর যাবত ইসরাইলী কারাগারে বন্দী ও গ্রেফতারকৃতদের আইনী সহায়তা দিয়ে আসছি। কারাগার থেকে কারাগারে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমি জানি যে, ৭ অক্টোবর থেকে কারাগার ও বন্দী শিবিরগুলোর অবস্থা প্রতিনিয়ত খারাপের দিকে গেছে। কিন্তু ‘এসডিই তাইমানে’ (ডেথ ক্যাম্পে) ৪৫ মিনিটের জন্য প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যা দেখেছি, এর মতো ভয়াবহ কোনো কিছুই এর আগে দেখিনি। এর আগে এমনকিছু শুনিওনি। এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত বন্দী শিবির হিসেবে পরিচিত আবু গারিব ও গুয়েন্তামোর ব্যাপারে যা কিছু শুনেছি, ডেথ ক্যাম্পের ভয়াবহতার এরচেয়ে আরো বহুগুণ বেশি। যা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।
হাজিনাহ বলেন, সেখানে ফিলিস্তিনি বন্দীদের ২৪ ঘণ্টা হাত,পা ও চোখ বেঁধে রাখা হয়। কোনো ধরণের বিছানাপত্র ছাড়া উদোম শরীরে ঠান্ডা মেঝেতে শুতে ও ঘুমাতে বাধ্য করা হয়। সপ্তাহে মাত্র ১মিনিটের জন্য হাত-পায়ের বেড়ি খুলে দেওয়া হয়। ১মিনিটের সাথে সাথে হাত-পায়ের বেড়ি পড়তে না পারলে বিভিন্ন ধরণের কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়। শাস্তি হিসেবে বিকৃত উপায়ে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনও করা হয়।
আমার মক্কেল সাংবাদিক মুহাম্মদ আরব আমাকে বলেছে, সে নিজেই ৬জন বন্দীকে অন্যান্য বন্দীদের সামনে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে বিশেষ লাঠি দিয়ে বিশেষভাবে যৌন নির্যাতন চালাতে দেখেছে। অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্ত্বেও আমার কাছে তার সবচেয়ে বড় চাওয়া ছিলো তার নির্যাতনের ভয়াবহতা যেনো সেই মাত্রায় না পৌঁছায়।
মুহাজিনাহ আরো জানান, বন্দীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার, উপযুক্ত চিকিৎসা ও অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। প্রায়ই নষ্ট খাবার খেতে দেওয়া হয়। শুধুমাত্র ১টুকরো পাউরুটি, ছোট শসা না হয় টমেটো খেতে দেওয়া হয়। বন্দীদের খুবই নোংরা পরিবেশে রাখা হয়। বন্দীদের প্রাথমিক ও মৌলিক পরিচ্ছন্নতা (গোসল, শৌচকার্য) অবলম্বনেরও পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া হয় না। পরিচ্ছন্নতা অবলম্বনের যে সময় দেওয়া হয় তা অপর্যাপ্ত হওয়ায় শাস্তির ভয়ে অধিকাংশ বন্দীই তা থেকে বিরত থাকেন। যথাযথ চিকিৎসা সেবা ও ঔষধ সরবরাহ না করায় বন্দীরা যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকেন। বন্দীদের ক্ষত ও জখম সাড়াতে যোগ্য ডাক্তারদের পরিবর্তে নার্সিংয়ের ছাত্রদের ব্যবহার করা হয়। অনভিজ্ঞ নার্সিংয়ের ছাত্ররা কোনো রকমের এনেস্থিসিয়া (অবশকরণ তরল) ছাড়াই বন্দীদের ক্ষত ও জখম সেলাই করে থাকে। ছোট ছোট কামরায় একত্রে শতাধিক বন্দীকে আটকে রাখা হয়। একে অপরের সাথে কথা বলা থেকেও বিরত রাখা হয়। কথা বলতে দেখলেই দেওয়া হয় ভয়াবহ শাস্তি। বড়দের পাশাপাশি অনেক শিশুকেও এখানে আটক রাখা হয়েছে। বন্দীদের নামাজ তো দূরের কথা, মানসিক নির্যাতনের মাত্রা ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে যেতে কুরআন তেলাওয়াত থেকেও বিরত রাখা হয়।
আইনজীবী খালেদ মুহাজিনাহ কারাগারে তার মক্কেলের অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, আমাকে দেখার পর তার চোখেমুখে ছিলো বিস্ময়ের ছাপ। কারণ, ইসরাইল তাদের ডেথ ক্যাম্পের ভেতর যে কাউকে প্রবেশ ও বন্দীদের সাথে দেখা করতে দেয় না এটি সেও জানে। তাই তার আইনজীবী হিসেবে দেখা করতে এসেছি শুনে আমাকে সে প্রমাণ করতে বলে যে, আমি প্রকৃতই আইনজীবী ; কোনো গোয়েন্দা নই।
সে আমাকে বলে, আমি কীভাবে বিশ্বাস করতে পারি যে, তুমি আসলেই আইনজীবী, কোনো গোয়েন্দা নও? আমি ১০০ দিন এখানে বন্দী। আমি ভালো করেই জানি যে, এখানে কাউকে আসতে দেওয়া হয় না। আইনজীবীদেরও না।
আইনজীবী মুহাজিনাহ বলেন, আমার সাথে দেখা করানোর জন্য তাকে অন্ধকার আবদ্ধ কামরা থেকে বাইরে আনার পর পরিপূর্ণ ভাবে চোখ মেলে তাকাতে তার কষ্ট হচ্ছিলো। দীর্ঘদিন পর আলোতে আসায় ৫ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে সে তার চোখ কচলাতে থাকে। পরিপূর্ণ চোখ মেলে তাকানোর পর, নির্যাতনের ভয়াবহতার ফলে তার চোখ মানসিক বিকারগ্রস্তের ন্যায় হয়ে গিয়েছে বলে আমি দেখতে পাই। আমাকে দেখার পর সে প্রথম যে কথাটি বলেছিলো, আমি কোথায়? আমাকে কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে?
সে আমাকে জানায় যে, আমার সাথে দেখা করানোর জন্য তাকে বের করার আগ পর্যন্ত চুল, চেহারা, ত্বক ও স্বাস্থ্যে সে ভিন্ন কোনো ব্যক্তি ছিলো। উকুন, ছাড়পোকা, কবুতরের পায়খানা সমেত নোংরায় পরিপূর্ণ ছিলো সে। ডেথ ক্যাম্পের সকল বন্দীদের অবস্থা একই রকম বলে জানায় সে। আমার সাথে সাক্ষাত করানোর জন্যই তাকে প্রথমবারের মতো ভালোভাবে পরিচ্ছন্নতা অর্জনের সুযোগ দেওয়া হয়। ১০০ দিনের বন্দীদশায় প্রথমবারের মতো প্যান্ট পাল্টানোর ব্যবস্থা করা হয়। কারাগারে সেই প্রথম ও একমাত্র ব্যক্তি যে এই সুযোগ পেয়েছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত কারাগার হিসেবে পরিচিত আবু গারিব ও গুয়েন্তানামোর চেয়েও কুখ্যাত ও ভয়াবহ কারাগারে প্রবেশের সুযোগ পাওয়া একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে আইনজীবী খালেদ মুহাজিনাহ বলেন, সাংবাদিক মুহাম্মাদ আরব কুখ্যাত কারাগারটির সকল বন্দীর পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, আদালাত ও সংস্থাগুলোকে তাদের মুক্ত করার ও বাঁচানোর জোর আকুতি জানিয়েছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আহবান জানিয়েছে।
ইসরাইলী ‘ডেথ ক্যাম্পের’ বর্ণনা তুলে ধরা এই আইনজীবী বলেন, এটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে যে, প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা নিয়ে গাজায় জিম্মি থাকা ইসরাইলীদের ব্যাপারে পুরো পৃথিবী কথা বলছে কিন্তু ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার ফিলিস্তিনি বন্দীদের ব্যাপারে কেউ কথা বলছে না।
গত মার্চ মাসে গাজ্জার আশ-শিফা হাসপাতাল থেকে অন্যান্যদের পাশাপাশি আল আরাবিয়ার ৪২ বছর বয়সী সাংবাদিক মুহাম্মাদ সাবের আরবকে তুলে নিয়ে যায় প্রায় ৯ মাস যাবত গণহত্যা পরিচালনা করে আসা ইসরাইলের সেনারা।